শরিফুল হাসান
বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে রাজধানী। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) হিসাব অনুযায়ী এর সংখ্যা অন্তত আড়াই হাজার। কিন্তু অনুমোদন আছে মাত্র ৩০০ বিলবোর্ডের। বাকিগুলো অবৈধ, যে যার মতো করে যেনতেনভাবে গড়ে তুলেছে।ডিসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, অনুমোদনহীন এসব বিলবোর্ডের কারণে নগরে যেমন সৌন্দর্যহানি হচ্ছে, তেমনি নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে আছে সাধারণ মানুষ। কারণ সামান্য ঝড়-বাতাসেই এগুলো ভেঙে পড়ে। গত সোমবার রাতে গুলশানে এমনই একটি বিলবোর্ড ভেঙে দুজন নিহত হন। এ ঘটনায় গুলশান থানায় একটি মামলাও হয়েছে।ডিসিসি গুলশান অঞ্চলের (অঞ্চল-৯) নির্বাহী কর্মকর্তা রওনক আহমদ করপোরেশনে পাঠানো এক ফ্যাক্সবার্তায় বলেন, গুলশান এলাকায় অবৈধ অনেক বিলবোর্ড আছে। বর্ষা মৌসুমে যেকোনো সময় এসব বিলবোর্ড ভেঙে পড়তে পারে। এ জন্য অবৈধ এসব বিলবোর্ড উচ্ছেদ করা জরুরি।ডিসিসি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের সৌন্দর্যবর্ধন ও বিজ্ঞাপন নীতিমালা-২০০৯ অনুযায়ী যেকোনো বিলবোর্ড তোলার আগে ডিসিসির অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ নিয়ম না মেনে প্রভাবশালী মহল ইচ্ছামতো বিলবোর্ড গড়ে তুলছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক নেতা। তবে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর অভিযোগ, বিলবোর্ড করতে হলে কার অনুমতি নিতে হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এত সমস্যা হচ্ছে। আউটডোর বিজ্ঞাপনী সংস্থার সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরের অধিকাংশ বিলবোর্ড বাড়ির ছাদে। এসব ভবন দেখভালের দায়িত্ব রাজউকের, ডিসিসির নয়। কাজেই এখানে বিলবোর্ড তুলতে হলে রাজউকের কাছ থেকেই অনুমতি নেওয়া উচিত। কিন্তু রাজউক কোনো বিলবোর্ডের অনুমতি দেয় না। ফলে সমস্যা হচ্ছে। রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) শেখ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বিলবোর্ড বা বিজ্ঞাপনী সংস্থার বিজ্ঞাপনের বিষয়ে রাজউকের কোনো নীতিমালা নেই। রাজউক কোনো অনুমতিও দেয় না। কাজেই ডিসিসির কাছ থেকেই অনুমতি নিতে হবে। এখানে রাজউকের কিছু করার নেই। ডিসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা শহরের অধিকাংশ বিলবোর্ডই দুর্বল অবকাঠামোর ওপর গড়া। এর মধ্যে বিভিন্ন ভবন, ছাদ ও দেয়ালে স্থাপিত বিলবোর্ডগুলো অধিক ঝুঁকির সম্মুখীন। এ ছাড়া রাস্তার পাশে স্থাপিত বিলবোর্ডগুলো যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীদের জন্য হুমকিস্বরূপ।ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডিসিসির কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া বিলবোর্ডের সংখ্যা মাত্র ৩০০। কিন্তু রাজধানীতে অনুমোদন ছাড়া হাজার দুয়েক বিলবোর্ড আছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরে যেকোনো বিলবোর্ড তুলতে হলে অবকাঠামো প্রকৌশলীর অনুমতি নিতে হয়। এগুলো এমনভাবে করতে হয়, যাতে ঝড়-বৃষ্টিতে ভেঙে না পড়ে। নিয়ম মেনে লাগানো একটি বিলবোর্ডও ভেঙে পড়েনি। কিন্তু ডিসিসির অনুমতি ছাড়া লাগানো বিলবোর্ডগুলো সব সময়ই ঝুঁকিতে থাকে।গুলশান এলাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, অবৈধ ও অপরিকল্পিত বিলবোর্ডের বিরুদ্ধে ডিসিসির নিয়মিত অভিযান চালানোর কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয় না। কখনো কখনো উচ্ছেদ অভিযান চালালেও আবার নতুন বিলবোর্ড গড়ে ওঠে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, সীমাবদ্ধতা থাকলেও ডিসিসি নিয়মিতই অভিযান চালাচ্ছে। চড়া দামে ছাদ ভাড়া: ডিসিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার অনেক ভবন-মালিক কোনো নীতিমালা না মেনেই বাড়ির ছাদে বিলবোর্ড লাগানোর অনুমতি দেন। বিশেষ করে বনানী, গুলশান ও ধানমন্ডি বিলবোর্ড ব্যবসায় সবচেয়ে দামি এলাকা হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকার প্রধান সড়কের ওপর যেসব ভবন আছে, তার মালিকেরা ভবনের ছাদ ভাড়া দিচ্ছেন চার থেকে সাত লাখ টাকায়। প্রধান সড়ক ছাড়াও ভেতরের সড়কের সুউচ্চ ভবনের ছাদ, যা দূর থেকেও নজরে পড়ে, এমন ছাদের ভাড়াও দুই থেকে তিন লাখ টাকা। অন্যদিকে বাণিজ্যিক এলাকা তেজগাঁও, মহাখালী, কারওয়ানবাজার, মতিঝিলসহ বাংলামোটর, ইস্কাটন, মগবাজার, মালিবাগ, কাকরাইল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন এলাকায় ভবনের ছাদের ভাড়া নির্ধারিত রয়েছে দুই থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত।ধানমন্ডির বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিলবোর্ডের কারণে বাচ্চারা খোলা ছাদে ছোটাছুটি করতে পারে না। বিজ্ঞাপনদাতারা শুরুতে বলেনি, কতটা স্থান বরাদ্দ হবে বিলবোর্ডের জন্য। শুধু তিনি একা নন, অনেকেই এখন ছাদে বিলবোর্ড ভাড়া দিয়ে সমস্যায় ভুগছেন।সমন্বয় নেই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে: ডিসিসি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরে রেলওয়ে, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজউক, ডিসিসি, ওয়াসা, মহানগর পুলিশ, রাজউকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের জমি আছে। এসব স্থানে বিলবোর্ড স্থাপনের জন্য কোনো সমন্বিত নীতিমালা নেই। ফলে যে যার মতো বিলবোর্ড গড়ে তুলছে। দুর্ঘটনা: বিলবোর্ড ভেঙে এর আগেও বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ঝড়ে বিজয় সরণি ও ধানমন্ডি এলাকায় চারটি বিলবোর্ড ভেঙে পড়ে। এর আগে গত বছর ১০ মে মিরপুরে অবৈধ একটি বিলবোর্ড ভেঙে বিদ্যুতের খুঁটির ওপর পড়ে।অভিযান চলবে: ডিসিসি সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ বিলবোর্ডগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চলে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টা থেকে ভোর পর্যন্ত শাহবাগ এলাকা, ২৬ মার্চ ধানমন্ডি মাঠ থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত এলাকা, আগামী ১ এপ্রিল কুড়িল মোড় থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত, ৮ এপ্রিল ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণি পর্যন্ত এবং ১৫ এপ্রিল আগারগাঁও মোড় ও সংলগ্ন স্থানে অভিযান চলবে। এ ছাড়া বিলবোর্ডের নীতিমালা নিয়ে ২৩ মার্চ ডিসিসি বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে।