শরিফুল হাসান
ইউরোপের দেশ, ভালো কাজ, ভালো বেতন—এমন কথা শুনে সুইডেনে গিয়েছিলেন ৩০০ জন বাংলাদেশি। কিন্তু কাজ না পেয়ে প্রতারিত ওই বাংলাদেশিরা এখন সেখানকার জঙ্গলে ভয়াবহ পরিবেশে অমানবিক জীবন যাপন করছেন। অনেকেই পালিয়ে সুইডেন ছেড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ সুইডেনের প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাসা-বাড়িতে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছেন।স্টকহোমের কেটিএইচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞানের ছাত্র হেদায়েতুল ইসলামের বাসায় এমনই কয়েকজন বাংলাদেশি উঠেছেন। তিনি টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানান, তাঁর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল এলাকায়। এই সূত্রে ধরে ছয়জন বাংলাদেশি তাঁর বাসায় এসেছেন, যাঁদের বাড়ি নাচোলে।বাংলাদেশি কর্মী আলমগীর আলী (পাসপোর্ট এ-০৩৯২৭৬২), আবদুল আলিম (জেড-০১৪১৪৩৪) ও হাসান আলী (জেড-০২৪৩৮৩১) টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানান, সুইডেন-প্রবাসী আবু বকর সিদ্দিক স্ট্রবেরি ফল তোলার কথা বলে বাংলাদেশ থেকে মোট ৩০০ শ্রমিককে নিয়ে আসেন। কথা ছিল, প্রতি মাসে সাড়ে ১৭ হাজার ক্রোনার করে তিন মাসে মোট বেতন ৫০ হাজার ক্রোনার বা দেড় লাখ টাকা।শ্রমিকেরা জানান, সুইডেনে আনার জন্য তাঁদের কাছ থেকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে তাঁদের সুইডেনে নেওয়া হয়। সুইডেনের উপসালা শহর থেকে অনেক দূরের জঙ্গল বরশেলে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। ২ থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত তাঁদের জঙ্গলে রাখা হয়। ওই জঙ্গলের পরিবেশ খুবই ভয়াবহ। জঙ্গলে ভালুকসহ অনেক প্রাণীর পাশাপাশি আছে মশা। ভয়াবহ এই পরিবেশে কাজ করলেও তাঁদের কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। উল্টো খাওয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫০ সুইডিশ ক্রোনার (দেড় হাজার টাকা) নেওয়া হয়। অথচ কথা ছিল, কোম্পানি পুরো খরচ দেবে। এর আগেও সুইডেনের বিমানবন্দরে নামার পর তাঁদের কাছ থেকে ১০০ ডলার করে নেওয়া হয়েছে।শ্রমিকেরা জানান, বিশাল জঙ্গলে মশার কামড় খেয়ে একের পর এক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ১০ দিন পরই তাঁদের জানানো হয়, এখন আর কাজ নেই। কোনো টাকাও এ বছর পাওয়া যাবে না। এ সময় সিদ্দিক তাঁদের বলেন, ‘তোমাদের সুইডেনে আনা হয়েছে সেংজেন ভিসা দিয়ে। তোমরা ইউরোপের যেকোনো দেশে পালিয়ে যেতে পারবে।’ অর্ধশত শ্রমিক এরই মধ্যে অন্য দেশে পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুইডেনের রাস্তাঘাটে।সুইডেনের কয়েকজন প্রবাসী জানান, বাংলাদেশিদের দুরবস্থার বিষয়টি নিয়ে কয়েক দিন আগে সুইডেনের বিভিন্ন দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবছর ফল তোলার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে লোক নেওয়া হতো। গত কয়েক বছর পোলান্ড, থাইল্যান্ড, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে কর্মী নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের পরিবেশ এবং বেতন কম দেখে শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেন। ফলে ওই সব দেশ লোক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। এ সুযোগে একটি চক্রের সহায়তায় এ বছর বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া হয়।সুইডেনের রিসকারমেট, ল্যাপল্যান্ড ও জানল্যান্ড—এই তিনটি প্রতিষ্ঠান শ্রমিক নিয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভিসায় সুইডিশ ভাষায় কাজের অনুমতিপত্র বা ‘ওয়ার্ক পারমিট’ কথাটি লেখা আছে। তাঁদের সবাইকে তিন মাসের রিটার্ন ভিসা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওয়ার্কফোর্স (আরএল-১০৯৫) এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বুর্যোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুইডেনের বাজার সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা ছিল না। তাই সুইডেনে লোক যাওয়ার অনুমতিও দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু সুইডেনে বাংলাদেশ দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বারবার অনুরোধেই বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়।এ বিষয়ে ই-মেইল ও টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব খন্দকার মাসুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর বাংলাদেশ থেকে ২৮১ জন শ্রমিক এসেছেন বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে। বাংলাদেশ ওয়ার্কফোর্স নামের একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা এসেছেন। শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা শোনার পর তিনি নিজেই অনেক ক্যাম্পে গিয়ে ওই শ্রমিকদের অবস্থা দেখে এসেছেন। যে পরিবেশে তাঁরা আছেন, সেটি অমানবিক। তিনি আরও জানান, ঘটনার পর থেকে আবু বকর সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সুইডেনের লেবার ইউনিয়ন ঘটনার তদন্ত করবে।