শরিফুল হাসান
ভাগ্যের অন্বেষণে সৌদি আরবে গিয়ে ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ মারা যান নজির মিয়া। এরপর পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। দরিদ্র নজিরের মা-বাবা ও স্ত্রী-সন্তানেরা অপেক্ষা করতে থাকেন লাশের জন্য। কিন্তু মাস গড়িয়ে বছর পেরোয়, লাশ আর আসে না। তবুও প্রতীক্ষার প্রহর গোনেন তাঁরা।হঠাৎ একদিন হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে খোঁজ করা হয় নজিরের বাবা ওয়াতির মিয়ার। এরপর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে নজির মিয়ার লাশ আনার জন্য আবেদন করেন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি)। বিএমইটির কর্মকর্তারা তৎপর হয়ে খোঁজ নেন দূতাবাসে। দূতাবাস থেকে জানানো হয়, লাশটি রাখা আছে রিয়াদের দাম্মাম হাসপাতালে।কিন্তু কেন একজন প্রবাসী বাংলাদেশির লাশ সাড়ে চার বছর ধরে মর্গে পড়ে আছে? এর আগে কেন দূতাবাস বা বিএমইটি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিল না? ওয়াতির মিয়া এতসব প্রশ্নের উত্তর চান না। তাঁর আবেদন, যে করেই হোক ছেলের লাশ দেশে আসুক। অন্তত তিনি যেন ছেলের কবর দিতে পারেন। তবে দূতাবাস ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের অবহেলার কারণেই লাশটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে।নজির মিয়ার বাড়ি হবিগঞ্জ সদরের রাজিউড়া ইউনিয়নের মির্জাপুরে। ওয়াতির মিয়া প্রথম আলোকে জানান, জমি-জমা বিক্রি করে ১৯৯৭ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি ছেলেকে বিদেশে পাঠান। সৌদি আরবের আল আবাদি ফাউন্ডেশনে রাজমিস্ত্রির চাকরি করতেন ছেলে। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ ছেলে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যান বলে খবর পান। তবে নিয়ম-কানুন না জানায় লাশ আনার জন্য দরখাস্ত করতে পারেননি। ওয়াতির মিয়া বলেন, ‘আমার বয়স ৭০ অইছে। আমি ওখন অসুস্থ। সাড়ে চাইর বছর অইয়া গেছে। ওখনো ছেলের লাশ পাইছি না। মরবার আগে একবার পোলার মুখটা দেখতাম চাই।’নজির মিয়ার স্ত্রী কুলসুমা খাতুন জানান, সৌদি আরব যাওয়ার পাঁচ বছর পর ২০০২ সালে তাঁর স্বামী একবার দেশে আসেন। এর পর চার বছর পর একবার এবং পরে আরেকবার এসেছিলেন। এর পর খবর পান স্বামী মারা গেছেন। কুলসুমা বলেন, ‘দুই পোলাপুরি নিয়া আমার খুব খষ্ঠ অয়। কপালো আছিল স্বামীর মরণ। আমি মাইন্না নিছি। এখন লাশটা দেশে ফেরত আউক। আমি তারে মাটি দিতাম চাই।’ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, লাশটি বর্তমানে দাম্মাম হাসপাতালের হিমঘরে আছে। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে এমন অনেক লাশ বছরের পর বছর মর্গে পড়ে থাকে। আমরা ঢাকা থেকে বারবার চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করেও অনেক সময়ে তাঁদের কাছ থেকে তথ্য পাই না। এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে।’ বিষয়টি নিয়ে সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করলে কেউ কথা বলতে চাননি।ঢাকায় বিএমইটির পরিচালক (কল্যাণ) মুহসিন চৌধুরী বলেন, ‘দূতাবাস থেকে কিছুদিন আগে হঠাৎ করে আমাদের জানানো হয়, দাম্মামের হাসপাতালে হবিগঞ্জের নজির মিয়া নামের একজনের লাশ পড়ে আছে। এর পর আমরা হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসককে খোঁজ নিতে বলি। লাশটি যেন দ্রুত দেশে আনা যায়, সে ব্যাপারে আমরা ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা চেষ্টা করছি। নজির যেখানে চাকরি করতেন, সেখানে থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে কি না, সেটিও আমরা খোঁজ নিচ্ছি।’নজির মিয়ার ছেলে আল আমিন (১৪) অষ্টম শ্রেণীতে আর মেয়ে লুৎফা খাতুন (১২) সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। শেষবার তারা বাবাকে দেখেছে সাড়ে পাঁচ বছর আগে। মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে লুৎফা বলে, ‘আপনারা আমার বাবার লাশটা এনে দেন। আমরা আর কিছু চাই না।’