শরিফুল হাসান
আমি মনে করি না ইউক্রেনে রাশিয়ার এই হামলা কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে! রাশিয়ার তো নয়ই! বরং এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পর যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা হবে রাশিয়াই। আর লাভবান যদি কেউ হয় সে আমেরিকাই।
অতিসত্ত্বর এই যুদ্ধ বন্ধ হওয়া দরকার। এ বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পরপরই আমি এই কথাগুলো লিখেছিলাম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আজকে দ্বিতীয় স্ট্যাটাসটা লিখছি কারণ ইউক্রেনজুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।
এই হামলায় রাজধানী কিয়েভসহ ইউক্রেনের ৮ অঞ্চলে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ১১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৬০ জন। হতাহত দ্রুত বাড়বে।
হামলায় লিভ ও খারকিভ শহর এবং খমেলনিতস্কি, সুমি ও তেরনোপিল অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও পানির সংকট দেখা দিয়েছে। হামলা হয়েছে কিয়েভ শহরে জার্মান কনস্যুলেটের একটি ভবনেও।কোন সন্দেহ নেই গত শনিবার ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে রাশিয়াকে যুক্ত করা কার্চ সেতুতে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইউক্রেনের ওপর ক্ষেপণাস্ত্রের স্রোত বইয়ে দিয়েছে মস্কো।
আজকের হামলার পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, রাশিয়া আবারও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের শিকার হলে একইভাবে জবাব দেওয়া হবে। অপর দিকে কিয়েভঘনিষ্ঠ বিভিন্ন দেশ ও জোটের নেতারা এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আমি আমার প্রথম স্ট্যাটাসে যা লিখেছিলাম আজ সেই কথাই আবার বলি।
যুদ্ধ সবসময় নির্মম। এ কারণেই আমি সব ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে। সে কারণেই ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান বা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই যুদ্ধ সংঘাত লাগুক আমার প্রাণ কাঁদে। আমি মনে করি অতিসত্ত্বর এই যুদ্ধ বন্ধ হওয়া দরকার। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রথম ছয়মাসের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটা প্রতিবেদন পড়েছিলাম। তাতে জেনেছিলাম, যুদ্ধের শুরু হতে ১০ অগাস্ট পর্যন্ত ১৩ হাজারের বেশি মানুষ ইউক্রেনে নিহত হয়েছে।
গুগল বলছে হামলায় দুই দেশের অন্তত ১১ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। অন্তত ২৫ হাজার আহত হয়েছেন। বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। আমি জানি না বাস্তব সংখ্যাটা আরো কতো বেশি। জানি না আরো কতো মানুষ স্বজনহারা হবে। শুধু কী হতাহত? জাতিসংঘ বলছে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর এ পর্যন্ত অন্তত এক কোটি বিশ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।এর মধ্যে ৫০ লাখের বেশি মানুষ পাশের দেশগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
আর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ইউক্রেনের ভেতরেই বাস্তুচ্যূত হয়ে অন্য অঞ্চলে চলে গেছে। ছয় মাসের যুদ্ধে ইউক্রেনে ভৌত অবকাঠামোর যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা সহজেই চোখে পড়ে। এক সময় যেখানে ছিল মানুষের ঘরবাড়ি এবং বড় বড় দালান-কোঠা, সেখানে এখন কেবল ধ্বংসস্তূপ।
যুদ্ধের সময় কেবল আবাসনের যে ক্ষতি হয়েছে, ১৮ জুন পর্যন্ত তার পরিমাণ ৩৯ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিক্স।তারা হিসেব করে আরও বলছে, যুদ্ধের সময় অবকাঠামোর মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৪ বিলিয়ন ডলার। শুধু তো রাশিয়া-ইউক্রেন নয় এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে গোটা পৃথিবীতে।
বিশ্বের অনেক দেশ ইউক্রেনের উৎপাদিত গমের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাস হতে রাশিয়া ইউক্রেনের বন্দরগুলো অবরোধ করে রেখেছে। ফলে খাদ্যসংকট বিশ্বজুড়ে। যুদ্ধ শুরুর পরপরই পশ্চিমা দেশগুলো ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে। রাশিয়াও কিছু পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে।
ফলে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা। যুদ্ধের শুরু থেকেই পরমাণু দুর্ঘটনা বা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা ফিরে এসেছে। সবমিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। আমি জানি, রাশিয়ার প্রতি ভালোবাসা থেকে এই বাংলাদেশের অনেক মানুষ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েছে। এ ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার সমর্থন ছিলো। কিন্তু তাই বলে যুদ্ধের পক্ষে তো কখনো কোন বিবেকবান মানুষ সমর্থন দিতে পারে না!
এই যুদ্ধ আসলেই কারো জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনবে। রাশিয়ার তো নয়নই। কারণ পৃথিবীর কোন দেশে দখলদারদের টিকে থাকার ইতিহাস নেই। এই বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে সেটা আর ভালো কে জানে! আমার মনে হয়, রাশিয়া ভেবেছিল দ্রুত ইউক্রেন দখল করে ফেলবে। সেখানকার অনেক মানুষের সমর্থন পাবে। কিন্তু সেটা হয়নি।
হওয়ার কথাও না। এই যে দেখেন কিয়েভের কাছে এবং উত্তরের আরও অনেক বড় শহরের কাছে যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়া যে বিরাট এলাকা দখল করেছিল, সেখান থেকে তাদের পিছু হটতে হয়েছে। আমার মনে হয় সামনে আরো খারাপ দিন আসছে।
যেই রাতে যুদ্ধ লাগলো সেইরাতে আমি জেগে জেগে ফের শিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমাটা দেখেছি। আমার খুব প্রিয় ছবি এটি। আপনারা যারা ছবিটা দেখেছেন তারা তো জানেন। যারা দেখেননি তাদের বলবো পারলে আজ রাতেই সিনেমাটা দেখেন। যুদ্ধ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখবেন।১৯৯৩ সালে এই সিনেমা মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি সহ-প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন স্টিভেন জাল্লিয়ান।
১৯৮২ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী অস্ট্রেলিয়ান লেখক থমাস কেনিয়েলি’র লেখা ‘শিন্ডলার্স আর্ক’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। জার্মান ব্যবসায়ী অস্কার শিন্ডলারের জীবনী অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছে।সিনেমার কাহিনী দারুণ মানবিক। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন অস্কার শিন্ডলার নামের এক জার্মান ব্যবসায়ী যিনি নাৎসি বাহিনীতে যোগ দিয়ে পোল্যান্ডে এসেছেন যুদ্ধের সুবিধ ’কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হতে।
নাৎসি এসএস বাহিনীর প্রধানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে এবং তাদের প্রচুর টাকা ঘুষ দিয়ে পোল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর ক্রাকাউয়ে তিনি একটি কারখানা তৈরি করেন।শিন্ডলার তার কারখানায় কাজের জন্য শুধুমাত্র পোল্যান্ডের ইহুদিদের নেন এই উদ্দেশ্যে যে, ইহুদিরা সস্তা শ্রম দেবে এবং এতে তার অনেক টাকা বেঁচে যাবে। কিন্তু একদিন কারখানায় নিয়োগ পাওয়া এক হাতওয়ালা এক বৃদ্ধ ইহুদি এসে শিন্ডলারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কারখানায় নিয়োগ দিয়ে জার্মান বাহিনীর অত্যাচার থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য।
শিন্ডলার নতুন করে ভাবতে বসেন। নতুন এক এসএস ক্যাপ্টেন এসে যখন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করে ধরে ধরে মানুষ এসে নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকেন সেটা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এরপর নানা উপায়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে ইহুদি শ্রমিক সংগ্রহ করে তার কারখানায় নিয়োগ দিতে শুরু করেন যাতে করে তাঁরা বেঁচে যান। একসময় যুদ্ধের গতি বদলাতে শুরু করে। জার্মানরা পরাজয়ের আশঙ্কা বুঝতে পেরে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কাজ বন্ধ করে মৃত ইহুদিদের দেহাবশেষ পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে জীবিতদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
শিন্ডলার জানেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যাওয়া মানে অবর্ননীয় অত্যাচার এবং মৃত্যু। শিন্ডলার তার কর্মীদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে আমোন গ্যোটকে বলেন, তিনি তার কর্মীদের পুরনো কারখানায় নিয়ে যেতে চান। আমোন প্রতিটি শ্রমিকের জন্য নির্ধারিত হারে অনেক টাকা দাবী করেন। নিজের সব টাকা দিয়ে শিন্ডলার তার সহকারী স্টার্নকে নিয়ে ১১০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেন। এই তালিকা শিন্ডলার্স লিস্ট বা শিন্ডলারের তালিকা নামে পরিচিত। এই তালিকার সবাই বেঁচে যান। যুদ্ধেল শেষে বেতারে ইউরোপে জার্মানদের পরাজয় এবং সোভিয়েত রেড আর্মির জার্মানি আক্রমণের খবর প্রচারিত হলে শিন্ডলার তার কারখানার ১১০০ শ্রমিকের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন।
তিনি নিজে জার্মান নাৎসি দলের সদস্য, তাই মার্কিন ও রুশ বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার এড়িয়ে কারখানার শ্রমিকদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চান। বিদায় বেলা কারখানার শ্রমিকেরা তাদের সবা সাক্ষরসহ একটি চিঠি শিন্ডলারকে দেন ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে। শিন্ডলার এ সময় কাঁদতে শুরু করেন। তিনি বলেন, আরও কিছু টাকা খরচ করে আরও মানুষকে বাঁচাতে পারতেন।
বাকিরা তাকে সান্ত্বনা দেন, “এই ১১০০ শ্রমিকের দিকে তাকিয়ে দেখুন এরা আজ আপনার জন্যই জীবিত রয়েছে।ইহুদি না হয়েও যারা ইহুদী গণহত্যার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইহুদিদের জীবন বাঁচিয়েছেন তাদের ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল “রাইচাস এমং দ্য নেশন” সন্মাননায় ভূষিত করে। অস্কার শিন্ডলারের মৃত্যুর পর ইসরায়েল সরকার তার মৃতদেহ জার্মানি থেকে এনে তাকে এই সন্মাননা দিয়ে জেরুজালেমে সমাহিত করে।সিনেমার শেষের দৃশ্যগুলো ভীষণ মানবিক।
কতোবার যে কেঁদেছি আমি বলে শেষ করতে পারবো না। বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা একটা সোনার আংটি শিন্ডলারের হাতে তুলে দেন যাতে হিব্রু ভাষায় লেখা “যিনি একজনের জীবন বাঁচান তিনি সমস্ত পৃথিবীকে বাঁচান”।আসলেই তাই। কোরানেও তাই আছে যে যিনি একজন মানুষের জীবন বাঁচালো সে যেন পুরো পৃথিবীকে বাঁচালো।
আর সেই আমরা যখন যুদ্ধের নামে, সংঘাতের নামে, স্বার্থের নামে মানুষ হত্যা করি আমার ভীষণ কান্না পায়। চলুন আমরা সবাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। মানবতার কথা বলি। ভালোবাসার কথা বলি। এই পৃথিবীকে বাঁচানেরা জন্য ভালোবাসার কোন বিকল্প নেই। আসুন আমরা হিংসা বিদ্বেষ ভুলে যুদ্ধ বন্ধের কথা বলি। মানুষকে ভালোবাসি। মানবতার জয় হোক!