বাংলাদেশ টেলিভিশন

Spread the love

চার যুগ পেরিয়ে

শরিফুল হাসান


২৫ ডিসেম্বর চার যুগ পূর্ণ করল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। একদিন অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে শুরু হয়েছিল তাদের কার্যক্রম। বিটিভির ৪৮ বছরের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এবার জেনে নেওয়া যাক এই প্রতিষ্ঠানের নানা গল্পছোট্ট স্টুডিও ঘর। বেদির ওপর বসে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন শিল্পী জাহিদুর রহমান। গান চলাকালে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে প্রযোজকের নির্দেশ ক্যামেরার ক্লোজআপ করতে হবে। চিত্রগ্রাহক ১০০ কেজি ওজনের ডলির চাকা তুলে দিলেন শিল্পীর পায়ের আঙুলের ওপর। ডলির চাপে পায়ের আঙুল রক্তাক্ত। কিন্তু শিল্পী পুরোটা সময় হাসিমুখে গান গাইলেন। ঢাকায় টেলিভিশন যাত্রা শুরুর প্রথম দিককার ঘটনা এটি। আজকের আধুনিক ক্যামেরা আর যন্ত্রপাতির দিনে এ ঘটনা অবিশ্বাস্য শোনালেও বাস্তবতা হলো শিল্পী, কলাকুশলী সবার ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়েই ২০ বাই ৪০ ফুটের একটি মাত্র স্টুডিওতে যাত্রা শুরু হয়েছিল এ দেশের টেলিভিশন যুগের। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক) পরীক্ষামূলকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল পাকিস্তান টেলিভিশন—আজকের বাংলাদেশ টেলিভিশন। ২৫ ডিসেম্বর বিটিভি পূর্ণ করল তার চার যুগ। কিন্তু পাকিস্তান সরকার কেন ঢাকায় টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করতে গেল? ১৯৬৪ সালে যাঁর হাত দিয়ে ঢাকায় টেলিভিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই জামিল চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন ওই ঘটনা। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালেও তিনি শুনিয়েছেন নানা গল্প। সময়টা ১৯৬৩ সাল। পাকিস্তানের সামরিক সরকার আইয়ুব খান নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে নির্বাচনের আগেই ঢাকা ও লাহোরে একটি করে টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপনের চিন্তা করেছেন। সেই সূত্রেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক জামিল চৌধুরীর কাছে প্রস্তাব এল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঢাকায় একটি টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপন করা যায় কি না, সে বিষয়ে একটি জরিপ চালানোর। সেই জরিপের বেশ কিছুদিন পর ১৯৬৪ সালের ২৬ মার্চ জাপানের নিপ্পন ইলেকট্রিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুজিমা করাচিতে জামিল চৌধুরীকে পরীক্ষামূলক টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপন এবং ৯০ দিনের জন্য তা পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেন। কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যান জামিল চৌধুরী। ১ এপ্রিল কেন্দ্রাধ্যক্ষ হয়ে ঢাকায় ফেরেন তিনি । সিদ্ধেশ্বরীতে নিজের বাসভবনের একটি খালি অংশে টেবিল-চেয়ার পেতে অফিস সাজান। সেই সঙ্গে খোঁজ করেন একটি ভবন, যেখানে স্টুডিও করার মতো অন্তত ১৩-১৪ ফুট উঁচু ছাদসহ একটি বড় হলঘর থাকবে। ডিআইটি ছিল তখন ঢাকার সবচেয়ে উঁচু ভবন। কাজেই সেখানে স্টুডিও করার সিদ্ধান্ত হলো। তিন মাস পর জামিল চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দসংগীতশিল্পী কলিম শরাফী যোগ দিলেন অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে। ডিআইটি ভবনের একটি হলঘরে চলল সব প্রস্তুতির কাজ। জামিল চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘আমাদের একটি লক্ষ্য ছিল দাপ্তরিক কাজকর্মে বাংলা চালু করা। সে সময় ওই কাজে আমাকে সাহায্য করেছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস (বর্তমানে নোবেলজয়ী)। টেলিভিশনের ট্রান্সমিটার রুম, অন এয়ারসহ কারিগরি বিভিন্ন শব্দের বাংলা করে দিলেন মুনীর চৌধুরী। সব প্রস্তুতি শেষে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর আইয়ুব খান এসে উদ্বোধন করলেন টেলিভিশনের। উদ্বোধনের পর ৫০ মিনিটের একটি ছায়াছবি প্রদর্শিত হয়। এরপর কয়েকটি বিজ্ঞাপন। এরপর ১০ মিনিটের সংগীত অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে ফেরদৌসী বেগম (ফেরদৌসী রহমান) দুটি গান পরিবেশন করলেন।’ স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র হয়ে যায় ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন করপোরেশন ঢাকা’। ১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত রাষ্ট্রপতির ১১৫ নম্বর আদেশবলে এর নাম হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন। ১৯৭৫ সালের ৬ মার্চ রামপুরার নবনির্মিত আধুনিক যন্ত্রসজ্জিত ভবনে যায় বিটিভি।আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিটিভির কর্মীদের অবদান কম নয়। ১৯৭১ সালের ৭ থেকে ২৫ মার্চ মুস্তাফা মনোয়ারের নেতৃত্বে প্রচারিত টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেদিন সেনানিবাস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি। ঢাকা টেলিভিশনের কর্মীরাও সেদিন টেলিভিশনের পর্দায় পাকিস্তানের পতাকা বা পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত প্রচার করেননি। এ জন্য অবশ্য রাত সাড়ে নয়টা থেকে ‘আজ বাংলাদেশের হূদয় হতে’ এই একই গান বাজানো হয়। ২৩ মার্চ পেরিয়ে যাওয়ার পর রাত ১২টা এক মিনিটেই ঘোষিকা জানান, আজ ২৪ মার্চ ১৯৭১। আজকের অনুষ্ঠানের এখানেই সমাপ্তি। এরপর ২৪ মার্চ থেকেই ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র দখল করে নেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৯৬৪ সালে হাঁটি হাঁটি পা পা করে যে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই টেলিভিশন এখন পরিপূর্ণ যৌবনে। গোড়ার দিকে মাত্র ১০ মাইলের প্রচার ক্ষমতাবিশিষ্ট ট্রান্সমিটার নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিটিভি এখন সারা দেশে দর্শকেরা দেখতে পারে। আগে যেখানে দিনে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান হতো, এখন সেখানে প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টার অনুষ্ঠান হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশজুড়ে ১৪টি সম্প্রচার কেন্দ্র রয়েছে বিটিভির। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশি এলাকায় এখন বিটিভি দেখা যায়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৪৮ বছরের পথচলায় অনেক চড়াই-উৎরাই আছে, আছে নানা ইতিহাসের গন্ধ। সেই গন্ধ মেখে বিটিভি এগিয়ে যাক একুশ শতকের বাস্তবতায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.