ছয় বছরে ১৪ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে

Spread the love

এমন মৃত্যু মানা যায় না

শরিফুল হাসান

ভাগ্য ফেরানোর আশায় মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন সাতক্ষীরার যুবক এস কে মারুফ হোসেন। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায় জানানোর সময় স্বপ্নে বিভোর ছিল পরিবার। কিন্তু চার বছর পর গতকাল রোববার মারুফের লাশ নিতে একই বিমানবন্দরে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা।
এভাবে প্রতিদিনই গড়ে আট থেকে দশজন প্রবাসীর লাশ আসছে। গত মাসে (জানুয়ারি) এসেছে ২৪৯টি লাশ। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর এক দিনেই লাশ হয়ে দেশে ফেরেন ১৫ জন প্রবাসী শ্রমিক। এর মধ্যে ১০ জনের লাশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এই ১৫ জনের মধ্যে আটজন মারা গেছেন হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে আর পাঁচজন দুর্ঘটনায়। এদের গড় বয়স ৩৮। লাশ নিতে এসে তাঁদের স্ত্রী-সন্তান আর স্বজনেরা অঝোরে কেঁদেছেন। এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু তাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না।
২০০৮ থেকে ২০১৩—ছয় বছরে ৫৬টি দেশ থেকে লাশ এসেছে ১৩ হাজার ৮৭২ জন প্রবাসীর। এর আগে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এসেছে ছয় হাজার ১৭টি লাশ। আরও আগে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিন হাজার ৬১৩ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ আসার তথ্য আছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে।
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলো মৃত্যুর এই হার নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে এক কোটি লোক বিদেশে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আটটি লাশ আসা অসম্ভব কিছু নয়।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিদেশ থেকে যাঁদের লাশ আসছে, তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এঁদের ৩০ শতাংশ মারা গেছেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে। অন্যরা হূদেরাগ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, ক্যানসার, আত্মহত্যা কিংবা প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন। গত দুই বছরে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে যত প্রবাসীর লাশ এসেছে, তাঁদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রবাসী বাংলাদেশি, মৃতদের স্বজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত পাঁচটি কারণে বাংলাদেশিরা স্ট্রোক বা হূদেরাগের মতো সমস্যায় পড়েন। এগুলো হলো প্রতিকূল পরিবেশ, যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অমানুষিক পরিশ্রম এবং একই সঙ্গে বাড়িতে টাকা পাঠানোর চিন্তা, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপের কারণেই সাধারণত স্ট্রোক বা হূদেরাগের মতো ঘটনা ঘটছে।
দীর্ঘদিন সৌদি আরবে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করে এখন ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মাছুম সিরাজ। সৌদি আরবে কেন এত বাংলাদেশি স্ট্রোক বা হূদেরাগে মারা যান, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যে প্রচণ্ড গরম। সেখানে তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত থাকে। আমাদের শ্রমিকেরা যে পরিবেশে সেখানে কাজ করছেন, সেটা অমানবিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রম আইন মানা হয় না। আবার তাঁরা যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকেন। সেখানে অনেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান।’ তিনি মনে করেন, কাজের পরিবেশ বা থাকার পরিবেশ উন্নত করা ছাড়া এই মৃত্যু বন্ধের কোনো উপায় নেই।
অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসীদের এমন মৃত্যু মানা যায় না। যে বয়সে তাঁরা মারা যাচ্ছেন, সেই বয়সে হূদেরাগ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। তাঁরা যে পরিবেশে কাজ করছেন, যে মানসিক চাপ নিচ্ছেন, সেটাই মৃত্যুর বড় কারণ। সরকারের উচিত, সমস্যাটিকে গুরুতরভাবে নিয়ে এর সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।
ছয় বছরে ১৪ হাজার: সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮ সালে দুই হাজার ৯৮ জন, ২০০৯ সালে দুই হাজার ৩১৫, ২০১০ সালে দুই হাজার ২৯৯, ২০১১ সালে দুই হাজার ২৩৫, ২০১২ সালে দুই হাজার ৩৮৩ এবং ২০১৩ সালে দুই হাজার ৫৪২ প্রবাসীর লাশ এসেছে। অর্থাৎ, ছয় বছরে মোট ১৩ হাজার ৮৭২ জন প্রবাসীর লাশ এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। এর মধ্যে চার হাজার ২০৯ জনের লাশই (৩০ শতাংশ) এসেছে সৌদি আরব থেকে।
সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। ছয় বছরে এই সংখ্যা দুই হাজার ৩২৭ (১৬ শতাংশ)। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ছয় বছরে এসেছে দুই হাজার লাশ, কুয়েত থেকে ৮৮৬, ওমান থেকে ৬৬৪, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫২৩, ভারত থেকে ৪১০, বাহরাইন থেকে ৩৭৪, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩৪৫, কাতার থেকে ৩০৩, সিঙ্গাপুর থেকে ২৯৯, ইতালি থেকে ২৭৩, যুক্তরাজ্য থেকে ১৯৩, লেবানন থেকে ১৩১, লিবিয়া থেকে ১১৫, পাকিস্তান থেকে ১০২ এবং থাইল্যান্ড থেকে ৬৯ জন লাশ হয়ে ফিরেছেন। বাকি লাশগুলো এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে।
স্ট্রোক, হূদেরাগ আর দুর্ঘটনা: প্রবাসীদের লাশ এলে মৃত্যুর কারণ লিখে রাখা হয় বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কে। ২০১৩ সালে মারা যাওয়াদের মধ্যে দুই হাজার ৪৯৬ জন প্রবাসীর মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে দেখা গেছে, মাত্র ১৫৯ জনের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যুর হার মাত্র ৬ শতাংশ। ৯৪ শতাংশ প্রবাসীই অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মারা গেছেন স্ট্রোকে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ৭৪৯, অর্থাৎ ৩০ শতাংশ। হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে ৪৭০, কর্মক্ষেত্রে ও সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৬, অসুস্থতায় ২৯৮, ক্যানসারে ৬২ এবং আগুনে পুড়ে ২৬ জন মারা গেছেন। আর ১৯ জন আত্মহত্যা এবং নয়জন খুন হয়েছেন। ২০ জনের মৃত্যুর কারণ অজানা।
একইভাবে ২০১২ সালে মারা যাওয়া দুই হাজার ৩৭৭ জনের মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে দেখা গেছে, স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ১৫২ জনের (৬ শতাংশ)। স্ট্রোকে ৭৩০, হূদেরাগে ৩৩৬, অসুস্থতায় ২৫২, দুর্ঘটনায় ৭৫২, ক্যানসারে ৫৬ ও আগুনে পুড়ে মারা যান আটজন। এ ছাড়া ১৩ জন খুন হয়েছেন, আত্মহত্যা করেছেন নয়জন। ৯৬ জনের মৃত্যুর কারণ অজানা।
সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খান বলেন, ‘আমাদের কর্মীদের কর্মপরিবেশ ও থাকার পরিবেশ ভালো করার জন্য আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কথা বলছি।’
অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন কারাম এশিয়া। এর সমন্বয়ক হারুন-অর-রশিদ মালয়েশিয়া থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত প্রবাসীর মৃত্যু মর্মান্তিক। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বলে আসছি, শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত করা হোক। নিয়মিত ছুটি দেওয়া হোক। তাঁদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া হোক। কিন্তু কেউ তা শুনছে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.