শরিফুল হাসান
‘ছাত্রলীগ দিচ্ছে ডাক, সন্ত্রাসবাদ নিপাত যাক’। ‘শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি ছাত্রলীগের মূল নীতি’। ‘সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন গড়াই ছাত্রলীগের মূল লক্ষ্য’।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকলেই বিভিন্ন দেয়ালে লেখা এসব স্লোগান চোখে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলমের সৌজন্যে লেখা হয়েছে এ ধরনের স্লোগান। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সমাবেশেও সন্ত্রাস নির্মূলের কথা বলেন এই দুই নেতা। কিন্তু এখন তাঁরাই তাঁদের কর্মীদের সন্ত্রাসে আতঙ্কিত। গত সোমবার তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং কয়েকজনকে মারধর করে হলের তিনতলা থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চরম বর্বরতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।ওই সংঘর্ষের ঘটনায় ১৭ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলেও ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বহাল তবিয়তেই ক্যাম্পাসে ঘুরছেন। গতকাল ক্যাম্পাসের নতুন কলাভবনের সামনে দুই নেতাকে গল্প করতে দেখা যায়। এই দুই নেতার দাবি, সোমবার ক্যাম্পাসে যা হয়েছে, তা তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও ক্যাম্পাসের আশপাশে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়ার কাজেও জড়িয়ে পড়েছেন। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পক্ষের কর্মীদের মধ্যে সোমবার সংঘর্ষ বাধে।জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়া নিয়ে উত্তেজনা: ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন পান্দুয়া এলাকায় একটি জমির মালিকানা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে সমস্যা চলছিল। একপর্যায়ে জমির একজন মালিকের সঙ্গে ছাত্রলীগের সভাপতির সমঝোতা হয়। পরে জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য পাঁচ লাখ টাকায় সভাপতির সঙ্গে একজন মালিকের সমঝোতা হয়। ঘটনা জানতে পেরে সাধারণ সম্পাদক পক্ষের কর্মীরা জমির অন্য মালিকের পক্ষ নিয়ে সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা চলছিল।এ বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতি রাশেদুল বলেন, জমিসংক্রান্ত একটি সমস্যা নিষ্পত্তির বিষয়ে তাঁকে জানানো হলেও তিনি এতে সাড়া দেননি। তবে জমির একজন মালিকের একটি গাড়ি তিনি ভাড়ায় নিয়ে ব্যবহার করতেন বলে জানান।সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম বলেন, তিনি এ ধরনের কোনো ঘটনা জানেন না। তবে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী একটি জমির সাইনবোর্ড ভেঙেছে বলে তিনি শুনেছেন।ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী জানিয়েছেন, গত ১৯ মে রাশেদুলকে সভাপতি ও নির্ঝরকে সাধারণ সম্পাদক করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এর কয়েক দিন পর ১ জুন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হয়। এক মাস পর ১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় খোলে। নতুন কমিটির দুই নেতাই চাইছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার শুরুতেই নিজেদের শক্তির মহড়া দেখিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে।হলের নিয়ন্ত্রণ: আল-বেরুনী হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কর্মীদের মধ্যে কিছুদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। নতুন কমিটি গঠনের পর হলটি নিয়ন্ত্রণ করছিল সাধারণ সম্পাদক পক্ষের এনায়েত কবির (এমিল)। সভাপতি পক্ষের কর্মী মোস্তফা মনোয়ার সজীবও হলটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। এই হলটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পাওয়া সহজ হবে—এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন শীর্ষ নেতারা। এরই জের ধরে এমিল ও সজীবের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। সোমবার সজীবকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর জের ধরেই এমিল এবং পরে সাধারণ সম্পাদকের সমর্থকদের সংঘর্ষ বাধে।আল-বেরুনী হলের ছাত্রলীগের একাধিক কর্মী জানিয়েছেন, সজীব ও এমিলের মধ্যে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছিলেন রাশেদুল ও নির্ঝর।এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদুল ইসলাম বলেন, আল-বেরুনী হলের জুনিয়র কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকেই এ ঘটনা ঘটেছে। তবে সংঘর্ষের পেছনে অন্য কারও ইন্ধন থাকতে পারে।সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম বলেন, পদবঞ্চিত কিছু কর্মী ও কয়েকজন শিক্ষকের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটেছে। এগুলো ষড়যন্ত্র।ক্যাম্পাস থমথমে, পাল্টাপাল্টি মামলা, গ্রেপ্তার ১৬: সোমবারের সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাস এখন থমথমে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ও হলগুলোর সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। সভাপতি পক্ষের কর্মী মালেক এবং সাধারণ সম্পাদক পক্ষের হিমু বাদী হয়ে মামলাগুলো করেন।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, সোমবার রাত একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আ ফ ম কামাল উদ্দিন, শহীদ সালাম-বরকত ও আল-বেরুনী হলে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন আমিনুল, রাহাদ, সিহাব, হাসান, পরিতোষ, ইমন, রোমন, জাহিদ, রিয়াজ, মোস্তাফিজ, মাসুদ ও শামিম। অন্য চারজনের নাম জানা যায়নি। এই ১৬ ছাত্রকে গতকাল ঢাকায় বিচারিক হাকিম শাহরিয়ার আরাফাতের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত দুটি মামলায় তাঁদের প্রত্যেককে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন।উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আহতদের দেখতে তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।প্রক্টর আরজু মিয়া জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে জন্য প্রশাসন সতর্ক আছে।নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ: সংঘর্ষের সময় আল-বেরুনী হলের সামনে পুলিশ থাকলেও তারা কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। সংঘর্ষ থামানোরও কোনো চেষ্টা করেনি পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সংঘর্ষে অংশ নেন। সংঘর্ষের সময় ১১টি গুলি ছোড়া হয়। পরে কামাল উদ্দিন ও শহীদ সালাম-বরকত হলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে গোলাগুলির সময় সাধারণ সম্পাদক নির্ঝর আলম উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কাউকেই আটক করেনি পুলিশ।এ ছাড়া সংঘর্ষে জড়িত ১৭ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।চাঁদাবাজি ও পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ: আশুলিয়া থানার পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, চাঁদাবাজি ও পরিবহন ব্যবসার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার-সমর্থক ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সব সময়ই দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। নতুন কমিটি হওয়ার পর ক্যাম্পাসের বিশমাইল এলাকার একটি টেম্পোস্ট্যান্ড থেকে মাসিক হারে চাঁদা দাবি করে আসছিলেন সভাপতি পক্ষের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া নন্দন-ঢাকা পর্যন্ত চলাচলকারী বাস থেকে মাসিক হারে চাঁদা চেয়ে আসছিলেন তাঁরা। অপরদিকে সাধারণ সম্পাদক পক্ষের কর্মীরা সাভার এলাকার চিহ্নিত এক সন্ত্রাসীকে সঙ্গে নিয়ে আশুলিয়ার বিভিন্ন কারখানায় চাঁদার জন্য যান বলে জানা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কাজে একাধিক ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদা নিত দুই পক্ষই। কে, কোন জায়গা থেকে চাঁদা নেবে, এ নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই সমঝোতা হওয়ার কথা ছিল। তার আগে দুই পক্ষই নিজেদের শক্তির মহড়া দেখাতে চেয়েছিল। এসব নিয়ে যেকোনো সময় সংঘর্ষ হতে পারে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মহল থেকে জানানোও হয়েছিল বলে জানিয়েছেন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা।তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন। তাঁরা বলেন, স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তি তাঁদের বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যর্থতা: গত ১৮ মাসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০টি সংঘর্ষ ঘটেছে। এর মধ্যে সাত-আটটি বড় ধরনের।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যর্থতার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে। তাঁরা জানান, এই ক্যাম্পাসে কোনো একটি ঘটনা ঘটলে ছাত্রলীগের কয়েকজনকে বহিষ্কার কিংবা বা কিছুদিন কমিটির কার্যক্রম স্থগিত রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে কেন্দ্রীয় কমিটির ভূমিকা।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মাহমুদ হাসান বলেন, এগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগ। নির্বাচনের পরপরই ওই ক্যাম্পাসে এ ধরনের একটি সংঘর্ষের ঘটনার পর ছাত্রলীগের কার্যক্রম ১৪ মাস স্থগিত ছিল। এবারও কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে এবং ১৩ জনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটায়, তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সম্পর্ক নেই।সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ: ক্যাম্পাসে এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কঠোর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তামান্না, জাহিদ, মমিন ও রাজ বলেন, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এ ধরনের ঘটনাগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এ রকম একটি বর্বরোচিত ঘটনার পর ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা ক্যাম্পাসে ঘুরছেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জার। তাঁদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা উচিত।