শরিফুল হাসান
“যদি কখনো কোন ভুল করো, তবে তা সংশোধনে লজ্জা ও দেরি করো না।” খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কথাটা বলেছেন প্রাচীন চীনের প্রখ্যাত দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ কনফুসিয়াস। বছর পাঁচেক আগে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে হাঁটতে গিয়ে দেখি সেখানে নানা মনীষীদের উক্তি লেখা। এর মধ্যে কনফুসিয়াসের এই উক্তিটাও ছিল। আমি আসলে এই দর্শনটা অনুসরণ করি।
জীবনে চলতে গিয়ে আমাদের ভুল হয়। বিশেষ করে আমার মতো যারা মস্তিষ্কের বদলে মনের কথা শুনতে চেষ্টা করি, যারা সবসময় মানুষকে আগে রাখি, তারা যদি কখনো বুঝি ভুল হয়েছে, কেউ কষ্ট পেয়েছে, তিনি সিনিয়র হোক, জুনিয়র হোক, পদে বড় হোক, ছোট হোক সেটা সংশোধন করা উচিত।
আমি নিজে যেকোনো কিছু লেখার আগে বারবার ভাবি কোন ভুল হচ্ছে না তো! আমার এক জীবনে শত শত রিপোর্ট লিখেছি কিন্তু কোন ভুল রিপোর্ট করতে হয়নি। কোন ঘটনা নিয়ে স্ট্যাটাস লেখার আগেও আমি চেষ্টা করি যতটা সম্ভব খোঁজ-খবর নিয়ে লিখতে। একটা উদাহরণ দেই। এই আমি বহু কিছু নিয়ে লিখি কিন্তু কেন যেন সাম্প্রতিক মরিয়ম মেয়েটাকে নিয়ে লিখিনি। কারণ কথাগুলো আমার এলোমেলো লাগছিল।
বিশেষ করে তার মায়ের লাশ নিয়ে খবরটাতে। স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছিলেন এটা বয়স্ক কারো লাশ নয়। কিন্তু মরিয়ম দাবি করছিলেন তিনি শতভাগ নিশ্চিত এটা তাঁর মায়ের লাশ। মা উদ্ধারে সব মেনে নিলেও এই মিথ্যাটা মানতে পারছি না।ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ তিনি আমাকে দিয়ে ভুল জিনিস লেখান নাই। তারপরও যদি আমি লিখতাম তাহলে এতক্ষণে কয়েকবার সরি বলতাম। মরিয়মকেও সরি বলতে বলতাম।
আসলে সরি বললে বহু কিছু ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু আমরা অনেকেই কি ঘরে কি বাইরে, ভুল করেও সরি না বলে নিজের ভুলে অটল থাকি। এরপর ভুলের সংখ্যা বাড়াই। কখনো নিজের স্বার্থে কখনো নিজের শ্রেণীর স্বার্থে আবার কখনো কোন কারণ ছাড়াই নিজের ইগোর কারণে আমরা এই ভুলের সংখ্যা বাড়াই। অথচ নিজের ভুল বুঝতে পারলে নিজের ব্যর্থতা বুঝতে পারলে সে ভুল থেকেও ভালো কিছু হতে পারে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমার যদি কোন ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি, তা স্বীকার করতে আমার কোনোদিন কষ্ট হয় নাই। ভুল হলে সংশোধন করে নেব, ভুল তো মানুষের হয়েই থাকে। আমার নিজেরও একটা দোষ ছিল, আমি হঠাৎ রাগ করে ফেলতাম। তবে রাগ আমার বেশি সময় থাকত না। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোন কাজ করতে গেলে শুধু চিন্তাই করে। চিন্তা করতে করতে সময় পার হয়ে যায়, কাজ আর হয়ে ওঠে না।
অনেক সময় করব কি করব না, এইভাবে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোন কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তা ভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। পৃষ্ঠা নং-৮০ ও ৮১) আসলে নিজের ভুল বুঝতে পারা, সরি বলা, ধন্যবাদ বলা এগুলো আমাদের সংস্কৃতিতে খুব একটা নেই। অথচ এই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি শব্দের একটি ‘সরি’, আরেকটা ‘ধন্যবাদ’। কিন্তু আমরা এই দুটো শব্দ ব্যবহার করতে কার্পন্য বোধ করি বা বিব্রত হই।
অথচ হাজারও সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে ছোট্ট এই দুটি শব্দ। কনফুসিয়াসে ফিরি। কনফুসিয়াসের দর্শন ও রচনা চীনসহ পূর্ব এশিয়ার জীবনদর্শনে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। কনফুসিয়াস মূলত নীতিবাদী দার্শনিক ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে নীতিজ্ঞান। তাঁর মতে, নীতি না থাকলে একজন মানুষ যতো বড়ই হোক শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষের কাজে আসেন না। ভেবে দেখেন আমাদের নীতি কোথায়? বড় বড় লুটেরা অসৎ লোকের নীতি কোথায়? কোথায় রাষ্ট্রের নীতি?
আমরা প্রায়ই উন্নয়নের কথা বলি। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধগুলো কোথায়? আমি সব সময় বলি আজকে এই রাষ্ট্রের সংকটটা অর্থনীতির না, সংকটটা মূল্যবোধের। আজকাল পানের দোকানদারেরও লাখ টাকা আছে। কিন্তু এই রাষ্ট্রে মূল্যবোধ সম্পন্ন লোক খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। অথচ সবসময় আমাদের নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা করা উচিত।
আমি আসলে রোজ এই মূলবোধের কথা বলি। জানি না কে শুনছে, কে শুনছে না। তবে নিজেকে রোজ বলি, এই পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ নষ্ট হয়ে গেলেও আমাকে নষ্ট হওয়া চলবে না। কনফুসিয়াসে ফিরি। তিনি বলেছেন, কেউ যদি কোন ভুল করে আর সেটাকে সংশোধন না করে, তাহলে সে আরেকটা ভুল করছে। এভাবে ভুল শুধু বাড়তেই থাকে। চলুন ভাবি, আরেকটি ভুল করবো নাকি সরি বলে ভুলটা সংশোধন করবো! শুভ সকাল সবাইকে। শুভ সকাল বাংলাদেশ!