সাংবাদিক নাকি মার্কেটিং প্রতিনিধি?

Spread the love

রিপোর্টার কাম মার্কেটিং প্রতিনিধি। পদটা শুনতে অদ্ভুত না? বিস্ময়করও বটে। Ôসংবাদের সাথে প্রতিমুহুর্ত’ এই স্লোগান দিয়ে রিপোর্টার কাম মার্কেটিং প্রতিনিধি পদে নিয়োগের জন্য একটি দৈনিক পত্রিকা এই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। মোটেও ফাজলাম করছি না। অনলানইনের জব সাইটে এখনো জ্বলজ্বল করছে বিজ্ঞাপনটি। হায়রে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা!
আমি যতোটকু জানি বা যতোটুকু সাংবাদিকতা পড়েছি তাতে সাংবাদিকতার কোন বইয়ে এই নামে কোন পদ আছ বলে শুননি। একটি পত্রিকায় রিপোর্টার থাকতে পারে। মার্কেটিং প্রতিনিধিও থাকতে পারে। তাই বলে রিপোর্টার কাম মার্কেটিং প্রতিনিধি? 

সংবাদপত্র-সাংবাদিকদের জন্য করা বাংলাদেশ সরকারের ওয়েজ বোর্ডে কোথাও এই রিপোর্টার কাম মার্কেটিং প্রতিনিধি নামে কান পদ আছে বলে কখনো শুনিনি।

তবে তাত্ত্বিকভাবে না হোক বাস্তবে যে এই পদ আছে সেটা তো এই বিজ্ঞাপনে দেখাই যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনটিতে রিপোর্টার কাম মার্কেটিং প্রতিনিধির শিক্ষাগত যোগ্যতা চা্ওয়া হয়েছে স্নাতক। বেতন আলোচনা সাপেক্ষে। তব মজার বিষয় হল, বিজ্ঞাপনে রিপোর্টারের সম্পৃক্ত ব্যবসার কথা বলা হয়েছে, ক্যাবল কার, হিলি টপ রেস্টুরেন্ট, ফরেস্ট লিভিং, লেক ফিশিং, ভাসমান রাত্রিযাপন সহ ইত্যাদি সুবিধা।
আমি অবশ্য ভাসমান রাত্রিযাপন সুবিধার সঙ্গে রিপোর্টারের কী সম্পর্ক সেটা বুঝতে পারিনি। তবে এটা মোটামুটি বুঝেছি এই পত্রিকাটি এমন একজন রিপোর্টার চায় যে সাংবাদিকতা করবেন আবার এই কোম্পানির ব্যাবসার বিষয়টিও দেখবেন। এই বিজ্ঞাপন দেখে মনে হলো ভবিষ্যতে যদি কেউ মালিক বা সম্পাদকের পিএ কাম রিপোর্টার, বডিগার্ড কাম রিপোর্টার, বিজ্ঞাপনী কর্মকর্তা কাম রিপোর্টার, তদবিরবাজ কাম রিপোর্টার, পলিটিকাল কর্মকর্তা কাম রিপোর্টার, রিপোর্টার কাম ধান্দাবাজ এই ধরনের পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় তখন কী হব? অবশ্য নিয়োগ বিজ্ঞাপনই বা দিতে হবে কেন? বাস্তবে এইসব পদ না থাকলেও প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র অফিসেই সাংবাদিক কাম আরো কতো কী যে আছে সেটা তো আমরা জানি।
আমি খুব ডেডিকেশন নিয়ে এক যুগ আগে সাংবাদিকতা করতে এসেছিলাম। অন্য কোন পেশার কথা কখেো ভাবিনি। সেই অবজারভারে বিনা পয়সায় কন্ট্রিবিউিটং, বাংলাবাজারে মাসে তিন সাড় তিন হাজার টাকা বেতন, এরপর বিডিনিউজে ছয় হাজার টাকা হয়ে প্রথম আলোতে ছয় হাজার টাকায়। এখন দশগুন বেতন পেয়েও চারপাশ দেখে আজকাল খুব হতাশ লাগে। অথচ কয়েকবছর আগেও আমি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু ক্রমেই মনটা ভাঙ্গছে। একজন সত্যকিাররে সাংবাদিকের কাজ করার জায়গা বাংলাদেশে খুব কম। আজকাল আমার মনে হয় আমি ভুল করেছি। শুধু ভুল করেছি তাই নয়, আমি আমি আসলে ভুল সময়ে ভুল দেশে জন্মেছি।
সত্যি বলছি, একটি পত্রিকা যখন রিপের্টার কাম মার্কেটিং প্রতিনিধি চেয়ে বিজ্ঞাপন দেয় আমি হতবাক হয়ে যাই। এই পত্রিকিাটিকে দোষ দিয়ে লাভ কী? তারা তাদের মনের মধ্যে যা আছে পরিস্কার করেছে। অনেকে তো সেটা্ও করে না। তবে আমি আসলেই আজকাল বুঝতে পারি না দেশ আগাচ্ছে না পেছাচ্ছে। একটা জিনিষ বুঝতে পারি সততা, সম্মানবোধ, বিবেক, ন্যায়-অন্যায়, প্রতিবাদ এই শব্দগুলো এ দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এইদেশে এখন আর ঘুষ খাওয়া অপরাধ নয়। ঘুষ থাওয়ার অপরাধে কারো চাকুরিও যায় না। সমস্যা হয় তখুনি যখন ঘুষ খাওয়ার ভিডিও প্রকাশ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে মিলেমিশে এইদেশে দুই নম্বরি করে টাকা আয় করা আজকাল কোন অসম্মানের নয় বরং ক্রেডিটের বিষয়। আপনি যে পেশাতেই থাকেন না কেন কীভাবে টাকা আয় করছেন সেটা নিয়ে আজকাল কেউ চিন্তিত নয়, বরং আপনার টাকা আছে কিনা সেটাই হলো আসল বিষয়। বরং আপনি সৎভাবে টিকে থাকার সংগ্রাম করবেন সেটাই কঠিন এই সমাজে।
আবারো সেই বিজ্ঞাপনে ফিরি। পত্রিকাটি দেশের সব জেলায় একজন করে রিপোর্টার কাম মার্কেটিং প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে চায়। ভালো। জেলা প্রতিনিধি নিযোগ দিয়ে তাদের ব্যাবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এটাই বা কম কী? এই দেশের ৯০ ভাগ পত্রিকা বা টিভি তো তার জেলা প্রতিনিধদের বেতনই দেয় না। অনেকে তো আবার উল্টো জেলা প্রতিনিধদের কাছ থেকেই টাকা নেয়। এদেশের সবচেয়ে ভালো যে কয়েকটি পত্রিকা তার জেলার সাংবাদিকদের বেতন দেয় সেই বেতন শুনলে অনেকেই অবাক হবনে। একজন সাংবাদিকের বেতন অনেক অফিসের পিয়ন বা দারোয়ানের বেতনের চেয়ে কম। কী যে কষ্টে মফস্বল সাংবাদিকদের দিন কাটে, সেটা আমরা ঢাকায় সাংবাদিকতা করা অনেকে কোনদিন খোঁজও নেই না।


শুধু ঢাকার বাইরের কেন, ঢাকার সাংবাদিকরাও কী খুব ভালো আছে? এইদেশের কয়টা মিডিয়া আছে যে ঠিকমতো বেতন দেয়? প্রথম সারির হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদে বেশিরভাগের বেতন অনিয়মিত। ফলে মাস শেষে বাসাভাড়া, সন্তানের স্কুলের খরচ নিয়ে কতোজনকে যে দুরাবস্থায় পড়তে হয় তার কোন হিসেব নেই। এসব নিয়ে কখনো কী কেউ কোনদিন রিপোর্ট করে না। বরং ওই সাংবাদিককেই অন্য কারো পেশার দুরাবস্থা নিয়ে লিখতে হয়।

আগেও বলেছি, এখনো বলি আমরা সাংবাদিকরা সারাক্ষণ ন্যায় নীতি প্র্রতিষ্ঠার কথা বলি বা লিখি। সবাইকে উৎসাহিত করি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হ্ওয়ার কিন্তু নিজেরাই করি উল্টা আচরণ। তাই অনেক প্রতিষ্ঠান যখন মাসের পর মাস বেতন দেয় না, বিনা কারণে যখন আরেকজনকে চাকুরিচ্যুত করে তখন সাংবাদিকরা সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখান থেকে একজন সাংবাদিক ২০-২৫ বছর চাকুরি করে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তার প্রাপ্য সুযোগ সুবিধাটুকু্ও পায় না। এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না।
আমি মনে করি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই পেশার অনিয়ম নিয়ে অন্যায় নিয়ে কথা বলা উচিত সবার। কারা সাংবাদিক হতে পারবেন, কী কী যোগ্যতা থাকলে সাংবাদিক হওয়া যাবে,কোন প্রতিষ্ঠান বেতন না দিলে কী ব্যাবস্থা নেওয়া হবে, কোন সাংবাদিককে তার প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা না দিলে কী ব্যাবস্থা নেয়া  হবে এসব বিষয় নিয়ে সবার সোচ্চার হওয়া উচিত এখুনি।

নয়তো আজ রিপোর্টার কাম মার্কেটিং প্রতিনিধির বিজ্ঞাপন দেখেছেন কাল এর চেয়েও ভয়ঙ্কর কোন বিজ্ঞাপন দেখবেন। আর এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে একটি দেশের সাংবাদিকতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.