মিনারের স্বপ্নগুলো কী হারিয়ে যাবে?

Spread the love

আজ আমার ভীষন মন খারাপ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিট থেকে কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো অফিসে আসার পুরো পথটাই আমি কেঁদেছি মিনার নামে ছেলেটার কথা ভেবে। আল্লাহ কেন অসহায় মানুষগুলোর সঙ্গেই এমন করে?
জানতে চান কে এই মিনার? পুরো নাম মিনার উদ্দিন। বয়স ২৬। স্কুলে পড়া অবস্থায়ই ছাত্র পড়িয়ে ছেলেটি নিজের ও পরিবারের খরচ চালাতো। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুটোতেই জিপিএ–৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হন। সেখানেই ভালো ফলালফল। এরপর বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছিল ছেলেটি। ৩৬ তম বিসিএসে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর লিখিত পরীক্ষাও শেষ হয়েছে। এরমধ্যেই ছেলেটির জীবনে ঘটে গেলো ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা।

ঈদের ছুটিতে চট্টগ্রামে বাড়িতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছেলেটি এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটের নিবীড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছেলেটি। ইতিমধ্যেই তাঁর ডান হাত কেটে ফেলতে হয়েছে।তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের শারিরীক জটিলতা। তবে এতো যন্ত্রণার মধ্যেও ছেলেটির সাহসী উচ্চারণ ‘আমি বাঁচতে চাই। আমার স্বপ্নগুলো যেন শেষ না হয়ে যায়। আমি বিসিএসের ভাইভা দিতে চাই। আপনারা সবাই আমার পাশে থাকেন’।

মিনারকে আমি চিনি না। আজকের আগে কখনো দেখাও হয়নি। দুদিন আগে চট্টগ্রাম থেকে একজন ফোন করে জানালেন, মিনার নামে একটা ছেলে বার্ণ ইউনিটে আছে আমি যেন যাই। তাকে কথা দিলাম সোমবার যাবো।  এরমধ্যে রোববার বাসায় গিয়ে দেখি আমার বউয়ের ভীষন মন খারাপ। সারাটারাত সে ঘুমাতে পারছে না। কারণ জানতে চাইলে বললো ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু নাকি বিদ্যুতায়িত হয়ে বার্ণে। আমি বললাম আমাকে তো চট্টগ্রাম থেকে একজন এমন তথ্য দিলো। দুটো মিলিয়ে দেখলাম একই ছেলে।

যাই হোক সোমবার দুপুর। আমি বার্ণ ইউনিটের আইসিইতে ঢুকলাম। শান্ত সুন্দর চেহারার মিষ্টি ছেলে। পুরো শরীর নীল চাদরে ঢাকা। আমি ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। বললাম মনটা শক্ত রেখো। স্টিফেন হকিং কিন্তু হেরে যাননি। মিনারের কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলাম না। বেরিয়ে এলাম। ওর বন্ধুদের যতোটা পারি আমার সামর্থ্যঅনুযায়ী সাহায্য করলাম। বলে এলাম পাশে আছি।
মিনারের সংগ্রামের গল্পটা শুনতে চান? চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইনে মিনারের বাড়ি। তাঁরা তিন ভাই এক বোন। মিনার দ্বিতীয়। বাবা পেশায় গাড়িচালক। স্কুলে পড়া অবস্থায় তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মিনার ছাত্র পড়িয়ে আয় রোজগার করে বাবার চিকিৎসা করাতে থাকেন। এরমধ্যেই জিপিএ ৫ পেয়ে এএসসি। উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষে থাকা অবস্থায় ২০০৭ সালে বাবার মৃত্যু। পরেরবছর ২০০৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে মিনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ১৬ তম ব্যচে ভর্তি হন। থাকতেন এফ রহমান হলের ৩১৯ নম্বর কক্ষে। বিবিএতে ৩.৪০ এবং এমবিতে ৩.৬০ পান মিনার।

বন্ধুরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে চাকুরির পরীক্ষা দিতে শুরু করেন মিনার। ইতিমধ্যেই সাব রেজিস্ট্রার পরীক্ষায় প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সামনে লিখিত পরীক্ষা। আর ৩৬ তম বিসিএসের প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। ৬ সেপ্টেম্বর লিখিত পরীক্ষা শেষ করে ঈদের আগেরদিন ১২ সেপ্টেম্বর বাড়িতে যান। সেদিনই ঘটে এই দুর্ঘটনা। বাড়ির পাশের একটা ভবনে ছাত্রদের সঙ্গে গল্প করছিলো। সেখানে কটি বিদ্যুতের তার ঝুলে ছিল। তাতেই মারাত্মকভাবে বিদ্যুৎষ্পৃষ্ট হন।

মিনারের সহপাঠী মার্কেটিং এর ছাত্র শেখ শাহনেওয়াজ বলেন, ‘দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মিনার এতো পরিশ্রম করতো আমরা অবাক হয়ে দেখতাম। দারুণ ফুটবল খেলতো। স্ট্রাইকার ছিল। ওর কারণেই ২০১৪ সালে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আমরা ওকে আবার আমাদের মাঝে ফিরে চাই। কেউ সাহায্য করতে চাইলে ০১৯১৮১৬১০৪৭ নম্বরে বিকাশ করতে পারবেন। কেউ চাইলে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে সরাসরিও অর্থ সহায়তা করতে পারেন।

মিনারের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা বার্ণ  ইউনিট আইসিইউর পরামর্শক চিকিৎসক (কনসালটেন্ট)  মৌমিতা তালুকদারের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জানালেন, সাধারণ আগুনের চেয়ে  বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পোড়া রোগীদের অবস্থা খুব বেশি সংকটাপন্ন হয়। ওর শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এটি অনেক বেশি। ইতিমধ্যেই ওর একটি হাত কেটে ফেলতে হয়েছে।  শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। সোমবার বোর্ড বসে ওর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ধরনের রোগীদের দীর্ঘ সময় চিকিৎসা দরকার। ওকে ধৈয্য ধরতে হবে। বন্ধুবান্ধব এবং স্বজনদের উচিত ওর পাশে থাকা।

আমি মিনারের সব বন্ধুদের বলছি আমাদের ওর পাশে থাকতে হবে। এমন সংগ্রামী ছেলেকে আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনতেই হবে। প্রথমেই দরকার ওর সুচিকিৎসা। যতো টাকা দরকার যোগাড় করতে হবে। এরপর ওর মার্কেটিং বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সবাইকে ঘটনা জানাতে হবে। পিএসসির চেয়ারম্যান স্যারসহ সবার সাথে কথা বলতে হবে যাতে করে ও ভাইভা দিতে পারে। তবে সেগুলো পরের বিষয়। এখন কাজ ওর পাশে থাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছেলেকে আমার হেরে যেতে দিতে পারি না। চলুন আমরা যে যার জায়গা থেকে ওর পাশে দাঁড়াই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.