নেপথ্যে সেই টেন্ডারবাজ!
শরিফুল হাসান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের নেপথ্যে শিক্ষা ভবন ও আশপাশের এলাকার টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণ। সংঘর্ষে ইন্ধন দিয়েছেন ওই টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রক ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম। তাঁকে কর্মী দিয়ে সহায়তা করতেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু হলে সাংগঠনিক সম্পাদকের নেতৃত্বে আরেকটি পক্ষ শক্তিশালী হয়ে ওঠায় নিয়ন্ত্রণ কমার আশঙ্কায় হামলা চালান শফিকের সমর্থকেরা। ঘটে দুই পক্ষের বর্বর সংঘর্ষ।সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের এক গোপন প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, গোয়েন্দা পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একাধিক নেতাও সংঘর্ষের নেপথ্যের এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শফিক। তিনি ২০০০ সালের ২৬ জুন শিক্ষা ভবনে টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে গুলি চালালে সেখানকার পাঁচ কর্মচারী আহত হন। এতে ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা শফিকসহ ছাত্রলীগের চার ক্যাডারকে আটক করে পিটুনি দেন। শফিকের কাছ থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। ঘটনাটি পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছবিসহ প্রকাশিত হয়।শাহবাগ থানার সূত্র জানায়, চারদলীয় জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চুপ থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার টেন্ডারবাজি শুরু করেন শফিক। তাঁর হয়ে টেন্ডারবাজিতে অংশ নিতেন মুহসীন হলের ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি শেখ মুহাম্মাদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিনের কর্মীরা। বিনিময়ে শফিক নিয়মিত তাঁদের টাকা দিতেন। কয়েক দিন আগে তিনি তাঁদের তিন লাখ টাকা দেন। আওয়ামী লীগ বা এর কোনো সহযোগী সংগঠনে বর্তমানে শফিকের কোনো পদ নেই।সূত্র জানায়, পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শফিক শিক্ষা ভবনের সব দরপত্রের নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সেখানে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া কেউ সেখানে দরপত্র জমা দিতে পারে না। তিনি খাদ্য ভবন ও বিদ্যুৎ ভবনেও দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর হয়ে নিয়মিত টেন্ডারবাজিতে অংশ নিতে একটি গ্রুপ তৈরি করেন মুহাম্মাদ আলী ও মহিউদ্দিন। বিনিময়ে শফিক তাঁদের নিয়মিত টাকা দিতেন।বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, মুহসীন হলের ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে শফিকের টেন্ডারবাজির খবর অনেক দিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসনের জানা ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে মঙ্গলবারের সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম শাহবাগ থানায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে যে মামলা করেছেন, তাতে প্রধান আসামি শফিক। মুহাম্মাদ আলী ও মহিউদ্দিনকেও আসামি করা হয়েছে। তবে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।এ বিষয়ে শাহবাগ থানার পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, পুলিশ ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পেলেই শফিকসহ জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হবে।অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে শফিকের মুঠোফোনে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। বক্তব্য জানতে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। তিনি আত্মগোপনে আছেন বলে জানিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ ছাত্রলীগের এক নেতা। তিনি দাবি করেন, ছাত্রলীগের সাবেক এক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও তাঁর লোকজন শিক্ষা ভবনের টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছেন। তাই তাঁরা যেকোনো মূল্যে শফিককে শিক্ষা ভবন থেকে সরাতে চাইছেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কে এম সাইফুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে শফিক শিক্ষা ভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় টেন্ডারবাজি করতেন। তাঁর ইন্ধনেই মুহসীন হলের ঘটনা ঘটেছে। এ কারণেই মামলায় তাঁকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে গাড়ি নিয়ে শফিকের লোকজন মুহসীন হলে আসতেন। আমরা সেই গাড়ি তাড়াও করেছি এবং পুলিশকেও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম।’শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম গতকাল বিকেলে বলেন, ‘শফিকসহ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। খবর ছিল, তিনি গতকালও শিক্ষা ভবনে গিয়েছিলেন। তবে পুলিশ সেখানে গিয়ে তাঁকে পায়নি।’শফিকের টেন্ডারবাজির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহমুদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুহসীন হলের ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাক না কেন, আমরা চাই পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিক। এ ঘটনায় জড়িতরা গ্রেপ্তার না হলে তা প্রশাসনের ব্যর্থতা।’তৃতীয় পক্ষের উত্থান: মুহসীন হল সূত্র জানায়, একসময় দূরত্ব থাকলেও টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে এক হন হল শাখার সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের এবং যশোর অঞ্চলের কর্মীদের সমর্থনে হলে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন সাংগঠনিক সম্পাদক মহিউদ্দিন মাহি। তাঁর বিরুদ্ধেও প্রতিপক্ষের কর্মীদের মারধর ও হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ আছে। তিনি যেকোনো সময় হল সভাপতিকেও বের করে দিতে পারেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এসব কারণেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে শক্তির মহড়া দেওয়ার নির্দেশ দেন শফিক। সর্বশেষ, হলে শফিকের অর্থায়নে বই বিতরণের অনুষ্ঠানে শফিক থাকায় মাহি বা ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারা ছিলেন না। মূলত এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই কয়েক দিন ধরে হলে দুই পক্ষের উত্তেজনা চলছিল, যার বহিঃপ্রকাশ মঙ্গলবারের সংঘর্ষ। শফিকের নির্দেশে মুহাম্মাদ আলীর পক্ষে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন বহিরাগত অংশ নেয়।ঘটনার পর থেকে মুহাম্মাদ আলী ও মহিউদ্দিনের মুঠোফোন বন্ধ রয়েছে। তাঁরা ক্যাম্পাসে নেই। সংঘর্ষে আহত মাহি পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।



