পানি ছাড়া দুর্বিষহ জীবন
শরিফুল হাসান

ঢাকার উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোড এলাকায় সাত দিন ধরে পানি নেই। সেখানকার বাসিন্দা মেজবাউল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘পানি ছাড়া এত দিন কী করে জীবন চলে, তা–ও এই রোজায়; সেটা কি ওয়াসা বোঝে?’
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বললেন, বাথরুম করে পরিষ্কার হবেন, সেই পানিটুকুও নেই। বাধ্য হয়ে অন্য এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এই এলাকায় ১০ হাজার মানুষ তো আর এলাকা ছাড়তে পারছে না। তাদের জীবনটা কী রকম দুর্বিষহ, একবার ভেবে দেখুন।
একই রকম যন্ত্রণার কথা জানালেন মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকের ৮ নম্বর সড়কের বাসিন্দা রাকিবুল বাসার। রাকিব জানালেন, ১১ দিন ধরে তাঁর বাসায় পানি নেই। সমস্যা সমাধানেরও যেন কেউ নেই।
শুধু উত্তরা বা মোহাম্মদপুর নয়, ঢাকার মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা, যাত্রাবাড়ী, বনশ্রী, নাখালপাড়া, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ রাজধানীর শতাধিক বাসিন্দা পানি নিয়ে তাঁদের সীমাহীন দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন প্রথম আলোকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, রোজা শুরু হয়ে গেলেও পানির সমস্যা সমাধানে যথাযথ উদ্যোগ নিচ্ছে না ওয়াসা।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকেই পানিসংকট নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। ‘ডেসপারেটলি সিকিং-ঢাকা’সহ নানা গ্রুপে সমস্যার সমাধানও চাইছেন অনেকে। তাঁদেরই একজন উম্মে হুমায়ুরা। তিনি লিখেছেন, ‘মিরপুরের পূরবী থেকে কালশী—সাত দিন ধরে পানি নেই। কবে আসবে কেউ জানে না। আপনারা কি কেউ বলতে পারেন, ওয়াসার কর্মকর্তারা কবে আসবেন? রোজার দিন যে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে।’
নগরবাসীর অভিযোগ, আগে কোনো এলাকায় এক–দুদিনের বেশি পানির সমস্যা না থাকলেও এখন অনেক এলাকায় ৩ থেকে ১০ দিন ধরে পানির সমস্যা চলছে। আফতাব নগর এলাকার বাসিন্দা মেহেদি হাসান জানালেন, মেরুল আনন্দনগর ও আফতাব নগর–সংলগ্ন এলাকায় সাত দিন ধরে পানি নেই। মধ্যবাড্ডা এলাকার নামাপাড়ায় সাত দিন ধরে পানি নেই বলে জানালেন ফাতেমা ফেরদৌস। দনিয়ার এ কে স্কুল এলাকায় সাত দিন ধরে পানি নেই বলে জানালেন সেখানকার বাসিন্দা মীর মোজাম্মেল।
একটি প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান জুয়েল ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিরপুর ১ এলাকায় এক সপ্তাহ ধরে পানি নেই। উন্নয়নের এই যুগে আজ মানুষে মানুষে ব্যবধান কমে গেছে। বস্তিবাসীসহ সর্বস্তরের লোকজনের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়েও পানি পাইনি। ১০ লিটার পানি কিনে পাঁচতলায় উঠি। এই দিয়ে একেক দিন রান্নাবান্নাসহ সব চলছে।’
খায়রুজ্জামান কামাল জানালেন, শ্যামলীর আদাবর হাউজিং সোসাইটি এলাকায় পানি নেই। উত্তর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শাহানা আক্তার বলেন, ‘পানির সমস্যা তীব্র। এই পানির দুশ্চিন্তায় আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে।’ পানির সংকটে বনশ্রীর সি এবং ডি ব্লকের বাসিন্দাদের রোজার দুটি দিন কষ্টে কাটাতে হয়েছে বলে জানালেন সেখানকার বাসিন্দা সাইফুল কবির।
নাজমুল ইসলামের অভিযোগ আশকোনা, দক্ষিণখান এলাকার পানির সংকট নিয়ে। সোহানুর রহমান জানালেন, নাখালপাড়ায় পানি নেই তিন দিন ধরে।
মিরপুরের ২২ তলা পোশাক কারখানার উল্টো দিকের কালশী বাজারে ১০-১২ দিন ধরে পানি নেই। আইনজীবী মাহমুদ ওয়াজেদ জানালেন, মিরপুর ১ নম্বরের সলিম উদ্দিন মার্কেট এলাকায় চার দিন ধরে পানি নেই।
এ ছাড়া উত্তরা, মোহাম্মদপুর, আগামসি লেন, গেন্ডারিয়ায় রজনী চৌধুরী সড়ক, নারিন্দার লালমোহন সাহা সড়ক, উত্তর কমলাপুর, পূর্ব জুরাইন, জুরাইনের পূর্ব মুরাদপুর, শনির আখড়া, মাদারটেকের নন্দীপাড়া, লালবাগ, আজিমপুরের ছাপরা মসজিদের গলি, জিগাতলার হাজি আফসার উদ্দিন লেন, নাখালপাড়া বনফুল মোড়, মিরপুরের শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া, মিরপুর ১, মিরপুর ২, মিরপুর ১০, মিরপুর ১১, বালুঘাট, দক্ষিণখান, বনশ্রী, মধ্যবাড্ডা, মধুবাগ, শান্তিবাগসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পানিসংকটের অভিযোগ করেছেন নগরবাসী।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যাবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছরের তিন মাস যখন শুষ্ক মৌসুম থাকে, সে সময়ে আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। এখন সেই সময়। গত দু–তিন বছরে আমরা লোডশেডিং ভুলে গিয়েছিলাম। এবার ভয়াবহ লোডশেডিং হলো। ফলে উত্তরায় পুরো পানি সরবরাহব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এই সময়ে আমাদের মোটর পাম্পগুলো জ্বলে যায়। আবার পানির স্তর নিচে নেমে যায়। এ কারণেও সমস্যাগুলো হয়।’ তিনি বলেন, ‘শেখেরটেকে কিছু বাসায় পানি আছে, কিছু বাসায় সেই। আমরা সেখানে রেশনিং করছি।’
এ মুহূর্তে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারবেন কি না জানতে চাইলে তাকসিম এ খান বলেন, ‘যেখানে সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কর্মকর্তারা সমাধানের চেষ্টা করছেন। আগামী দুদিনের মধ্যে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারব বলে আশা করছি।’ ২০২১ সালে টেকসই ব্যবস্থায় গেলে এসব সমস্যা আর থাকবে না বলেও দাবি করলেন ওয়াসার এমডি।