জাল ভিসায় লিবিয়ায় গিয়ে ৪০ বাংলাদেশি আটক

Spread the love

শরিফুল হাসান

লিবিয়ার ত্রিপোলি বিমানবন্দরে ৪০ বাংলাদেশিকে আটক করেছে অভিবাসন পুলিশ। তাঁদের সবার ভিসা জাল। বাংলাদেশ থেকে জাল ভিসা বানিয়ে তাঁদের সেখানে পাঠানো হয়েছে। এমনকি লিবিয়ার কোনো কোম্পানিতে কাজ করার অনুমতিপত্রও তাঁদের নেই। অভিবাসন পুলিশ শনিবার তাঁদের আটক করে গতকাল রোববারই আরেকটি ফ্লাইটে দুবাইয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।সেখানকার পুলিশ বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানিয়ে দিয়েছে, এই শ্রমিকেরা দুবাই থেকে কীভাবে দেশে ফিরবেন, সেই দায়িত্ব তারা নিতে পারবে না। লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি যেমন সংকটে পড়বে, তেমনি শ্রমবাজারও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।লিবিয়ার বাংলাদেশের শ্রম কাউন্সেলর আকবর হোসাইন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যে ভিসা নিয়ে শ্রমিকেরা এসেছিলেন, তা বাংলাদেশের লিবিয়ার দূতাবাস থেকে ইস্যু করা নয়। এই ভিসা জাল। এমনকি তাঁদের কাছে বিএমইটির (জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) কোনো ছাড়পত্রও নেই। অথচ এই ছাড়পত্র ছাড়া বাংলাদেশের কোনো শ্রমিকের বিদেশে আসার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের কয়েকটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও দালাল প্রতারণার মাধ্যমে সহজ-সরল এই শ্রমিকদের এভাবে অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিয়েছে। ওই শ্রমিকেরা বাংলাদেশের কয়েকটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামও প্রকাশ করেছে। ঢাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কৌশলে অভিযোগ অস্বীকার করে।লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে শ্রম, কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গতকাল সকালে জরুরি একটি ফ্যাক্সবার্তা পাঠানো হয়েছে। সেই বার্তা থেকে এবং দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, দুবাই থেকে শনিবার সকাল ১০টায় লিবিয়ান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে (এলএন-২৭৩) ৪০ বাংলাদেশি ত্রিপোলি বিমানবন্দরে নামেন। এরপর নিয়ম অনুযায়ী লিবিয়ার অভিবাসন পুলিশ তাঁদের পাসপোর্ট দেখে। কিন্তু ভিসা দেখেই তাদের সন্দেহ হয়। পুলিশ দেখে, ৪০ জনেরই ভিসা জাল এবং সেটি লিবিয়ার কোনো দূতাবাস থেকে ইস্যু করা নয়। ভিসাগুলো বিবর্ণ। ভিসার স্টিকারে নিয়োগকারী কোম্পানির নাম আল জোহরা লেখা হয়েছে; কিন্তু এ নামে লিবিয়ায় কোনো কোম্পানিই নেই। এরপরই পুলিশ লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে খবর দেয়। সেখানে যান দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর ও প্রথম সচিব আকবর হোসাইন।আকবর হোসাইন প্রথম আলোকে জানান, তিনি বিমানবন্দরে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। শ্রমিকেরা তাঁকে জানান, বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং কিছু দালাল তাঁদের কাছ থেকে দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা নিয়েছে। এরপর জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভিবাসন পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বিএমএইটির কোনো ছাড়পত্র ছাড়াই জেট এয়ারের ফ্লাইটে করে দিল্লি ও পাকিস্তান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে করাচিতে পাঠানো হয়। ১৩, ১৪ ও ১৫ অক্টোবর তিন ভাগে দিল্লি ও করাচি হয়ে তাঁরা দুবাইতে পৌঁছান।আকবর হোসাইন জানান, দুবাইয়ের বিমানবন্দরে তাঁরা দুই দিন ছিলেন। তাঁদের বলা হয়েছিল, দুবাইয়ে এসে জোহরা নামে একটি কোম্পানির টি-শার্ট ও ক্যাপ তাঁদের পরে থাকতে হবে। তাঁরা সেটি পরে যখন অপেক্ষা করতে থাকেন, তখন হঠাত্ অপরিচিত একজন এসে লিবিয়ান এয়ারলাইনসের টিকিট দিয়ে যায়। সেই টিকিটে তাঁরা লিবিয়ায় আসেন। তাঁদের বলা হয়েছিল, ত্রিপোলি বিমানবন্দর থেকে জয়নাল ও আলী নামে কোম্পানির দুজন লোক এসে তাঁদের নিয়ে যাবে। কিন্তু এর আগেই পুলিশ জাল ভিসা দেখে তাঁদের আটক করে।আকবর হোসাইন জানান, লিবিয়ার পুলিশ এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। গতকাল লিবিয়ার স্থানীয় সময় সকাল আটটায় (বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা) লিবিয়ান এয়ারলাইনসের আরেকটি ফ্লাইটে তাঁদের দুবাইতে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে জেট এয়ার ও পাকিস্তান এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে তাঁদের ঢাকায় যেতে হবে। কিন্তু তাঁদের কাছে ঢাকায় ফেরার টিকিট নেই।মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জরুরি বার্তায় বলা হয়েছে, দুবাইয়ে এই শ্রমিকেরা মানবিক বিপর্যয় এবং অসহায় হয়ে পড়বেন। কাজেই খারাপ কিছু ঘটার আগেই তাঁদের ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাই তাঁদের উদ্ধার করার জন্য দ্রুত দুবাইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে এভাবে কাজের অনুমতি ছাড়া কেউ যেন ঢাকা বিমানবন্দর ছাড়তে না পারেন, সে ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিএমইটির ছাড়পত্র ছাড়া কোনো শ্রমিকের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এর পরও যদি কেউ গিয়ে থাকেন, তা হবে অভিবাসন পুলিশের ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কিছুই করার নেই।এদিকে গতকাল সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অভিবাসন পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি বৈঠকে বলেছেন, তাঁরা আরও সতর্ক হবেন।অভিবাসন পুলিশের বিশেষ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখনো এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাননি। তবে কেউ বাইরে চাকরি করতে গেলে অবশ্যই বিএমইটির ছাড়পত্র লাগবে। ছাড়পত্র ছাড়া যদি কেউ বিমানবন্দর পার হয়ে থাকেন এবং এর সঙ্গে যদি কারও সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।৪০ জনের তালিকা: গাজীপুরের কালিয়াকৈরের রাইসুল ইসলাম; শ্রীপুরের সিরাজুল ইসলাম; ভৈরবের মইন উদ্দিন, হোসেন আহমেদ ও শাহিন মিয়া; পাকুন্দিয়ার আতাহার; নোয়াখালীর বাবু; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাদিস মিয়া; সরাইলের কোরবান উদ্দিন; নবীনগরের জাভেদ মিয়া; হবিগঞ্জের মোখলেস; নরসিংদীর মনোহরদীর রফিকুল ইসলাম ও সুমন মিয়া; সুনামগঞ্জের সবুজ মিয়া; ফেনীর সোনাগাজীর আবদুল্লাহ আল আরাফাত; কুমিল্লার লাকসামের মোখলেস; ঢাকার সূত্রাপুরের নাদিম হোসেন; নবাবগঞ্জের কালু; মেহেরপুরের গাংনীর বাবর আলী, মুকুল হোসেন ও সদরের রিপন; টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের লিটন ও সদরের বশিরউদ্দিন; মধুপুরের শফিকুল ইসলাম; মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের মামুন হোসেন ও রুবেল মিয়া; যশোরের হোসেন; ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মোমতাজ উদ্দিন; মাদারীপুরের মোকসেদ মোল্লা, হান্নান খান ও বাবুল; ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের শেখ সুমন; মৌলভীবাজারের হেলাল উদ্দিন; সিলেটের বালাগঞ্জের শেখ আমিরুল ইসলাম, আব্দুল আলিম ও সাইফুল ইসলাম; কুমিল্লার খোরশেদ আলম; শরীয়তপুরের নড়িয়ার জসিম হাওলাদার এবং মাগুরার মাহবুব ও মমতাজ উদ্দিন।আরও শ্রমিক যাওয়ার অপেক্ষায়: জরুরি ওই ফ্যাক্সবার্তায় বলা হয়েছে, আটক ৪০ জন শ্রমিক জানিয়েছেন, একই প্রক্রিয়ায় অবৈধভাবে লিবিয়ায় আসার জন্য আরও দেড় শ থেকে দুই শ শ্রমিক ঢাকায় অপেক্ষা করছেন। ঢাকার একটি দালালচক্র লিবিয়ার ভিসা জাল করে তাঁদের সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যগামী বিমানে না তুলে কৌশলে ভারত ও পাকিস্তান থেকে লিবিয়ায় পাঠাচ্ছে।কারা দায়ী: লিবিয়ার শ্রম কাউন্সেলর আকবর হোসাইন জানান, এই ৪০ জনের কেউই তেমন শিক্ষিত নন। তাঁরা বুঝতেও পারেননি কীভাবে তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, ঢাকার ফকিরাপুলের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত। তাঁদের অনেকেই জাফর ইন্টারন্যাশনাল, বিসমিল্লাহ্ ট্রাভেলস, স্টারলাইন ট্রাভেলস, ওমর ফারুক এন্টারপ্রাইজের শহীদ, ফকিরাপুলের শতাব্দী সেন্টার ও তাহেরা এভিয়েশন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোশাররফ নামের এক দালালের কথা বলেছেন।জাফর ইন্টারন্যাশনালের কার্যালয় ঢাকার নয়াপল্টনে। এ প্রতিনিধি গতকাল দুপুরে সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে ওই কার্যালয়ে যান। তিনি জানতে চান, এক ভাই গ্রামে থাকে, তাঁকে লিবিয়ায় পাঠাতে হলে কী করতে হবে? এ কথা শুনে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক সুনীল আগ্রহী হয়ে বসতে বলেন। তিনি বলেন, লিবিয়ায় তাঁরা নিয়মিত লোক পাঠাচ্ছেন। সেখানকার বাজারও ভালো। কিছুদিন প্রশিক্ষণ নিলেই গ্রামে থাকা ওই ভাই ভালো কাজ পাবে বলে জানান তিনি। কত লাগবে জানতে চাইলে বলেন, সব মিলিয়ে দুই লাখ ১০ হাজার টাকা। সরাসরি কোম্পানিতে কাজ। তবে দেরি করলে আর কাজ পাওয়া যাবে না। তিনি নিজের মুঠোফোনের নম্বর এবং কার্ড দিয়ে ভাইকে নিয়ে দ্রুততম সময়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।এর ঘণ্টাখানেক পর সাংবাদিক পরিচয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জাফর আহমেদের সঙ্গে। সাংবাদিক শুনেই তিনি বলেন, তাঁরা লিবিয়ায় কোনো লোক পাঠাচ্ছেন না। তবে কাগজপত্র তৈরি করছেন, যাতে ভবিষ্যতে লোক পাঠানো যায়। আপনার প্রতিষ্ঠানের লোকজন তো বলছে, লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেবেন। তাঁরা কীভাবে বলছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অফিসে অনেক দালালের আনাগোনা। তারা এ ধরনের কথা বলতে পারে। আপনার অফিসের ভেতরে কীভাবে দালাল গেল, জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলেননি। ভুয়া ভিসায় লিবিয়ায় লোক পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি চক্র এ ধরনের কাজ করছে বলে তিনিও শুনেছেন। তবে তিনি এর সঙ্গে জড়িত নন।ওই শ্রমিকেরা বিসমিল্লাহ্ ওভারসিজের নামও বলেছেন। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংগঠন বায়রার কাগজপত্র অনুযায়ী বিসমিল্লাহ্ ওভারসিজের কার্যালয় হাতিরপুলের সোনারগাঁও রোডে। গতকাল সেখানে গিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যালয় পাওয়া যায়নি। ওই ভবনের নিচতলার মেডিসিন প্লাজা নামের একটি ফার্মেসির ব্যবস্থাপক সুজন জানান, ‘অনেকেই এখানে এসে প্রতিষ্ঠানটি খোঁজে; কিন্তু আড়াই বছর আগে জনতার মার খেয়ে তারা এখান থেকে চলে গেছে।’বিসমিল্লাহ্ ওভারসিজের মালিক বি এম ফারুক আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে লিবিয়ায় লোক পাঠানোর কথা বললে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি জানান, লিবিয়ায় লোক পাঠাতে তিনি কাগজপত্র তৈরি করছেন। এখন অফিস কোথায় জানতে চাইলে বলেন, উত্তরায় নতুন অফিস নিয়েছেন।এবার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে লিবিয়ায় ভিসা জাল করে লোক পাঠানোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফারুক বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এটি মিথ্যা অভিযোগ। তিনি এখন আর লোক পাঠান না। অফিস বদলালেন কেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে একসময় অনেক অভিযোগ করা হয়েছিল। এখন তিনি কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত নন; কিন্তু চক্রান্তকারীরা তাঁর নাম বলছে।অভিযুক্ত আরেক প্রতিষ্ঠান ওমর ফারুক এন্টারপ্রাইজের মালিক হাবিবুর রহমানও একইভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই মন্দার কারণে জনশক্তি রপ্তানি ৫০ শতাংশ কমে গেছে। সবাই মিলে যখন আমরা বাজার ঠিক করার চেষ্টা করছি, তখন সৌদি আরবে ভুয়া চাহিদাপত্র, লিবিয়ায় এভাবে ভিসা জাল করার ঘটনা খুবই দুঃসংবাদ।’ যেসব প্রতিষ্ঠান এভাবে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.