শরিফুল হাসান
প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রায়ই কিডনী রোগে আক্রান্ত হন। এই যেমন কিশোরগঞ্জের সুজন মিয়া (২৯)। দুবাইতে কর্মরত অবস্থায় ২০১৮ সালে দুটো কিডনিই ৫০ শতাংশ ‘ড্যামেজ’ হয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে দেশে চলে আসেন।
১৫ লাখ টাকা ব্যয়ের সামর্থ না থাকায় পরিকল্পনা করলেও ভারতে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য যেতে পারেননি। পরবর্তীতে পরিচিত একজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে ঢাকার শ্যামলীর সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজি হসপিটালে (সিকেডি) মাত্র দুই লাখ টাকায় কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেন। বড় ভাই ফজলু মিয়ার একটি কিডনি নিয়ে এখন সুস্থভাবে বেঁচে আছেন সুজন।
শুধু সুজন নয় এভাবে হাজারো মানুষের কিডনী প্রতিস্থান করেছেন একন ডাক্তার কিন্তু কোন পারিশ্রমিক নেননি। উল্টো দেশের দরিদ্র কিডনি রোগীদের জন্য নামমাত্র মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন ও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য তৈরি করেছেন বিশেষায়িত এক প্রতিষ্ঠান। যতোটা মনে পড়ে গতবছর প্রথম এই খবরটা পড়ি। এরপর থেকেই ডাক্তার কামরুল নামের মানুষটাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি।
গত কয়েকদি ধরে তাকে নিয়ে ফের আলোচনা হচ্ছে। আমি মনে করি এই ধরনের মানুষকে নিয়ে রোজ আমাদের দিন শুরু করা উচিত যাতে করে আমরা মানুষ হতে পারি। অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ১৯৮২ সালে তখনকার ৮টি মেডিকেল কলেজের সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস অব এডিনবার্গ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা আমিনুল ইসলাম পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার ‘অপরাধে’ স্থানীয় রাজাকার ও বিহারীরা তাকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার অনুপ্রেরণা আর মানবসেবার মহান ব্রত থেকেই চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলে অধ্যাপক কামরুল। ১৯৯৩ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন কামরুল ইসলাম। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। প্রথমবারের মতো সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করেন ২০০৭ সালে। দেশের কিডনী আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে অধ্যাপক কামরুল ইসলাম চাকুরি ছেড়ে দিয়ে শ্যামলীতে প্রতিষ্ঠা করেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল। গরীব রোগীদের কম মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন ও চিকিৎসার লক্ষ্য নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেন। নির্ধারিত ন্যূনতম খরচ বাদে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বিশেষজ্ঞ সার্জনের কোনো ফি নেন না অধ্যাপক কামরুল। অধ্যাপক কামরুলের হাসপাতালে ২ লাখ ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এই সেবায় ১৫ দিনের প্যাকেজের মধ্যে আছে ২ জনের অস্ত্রোপচার খরচ (রোগী ও ডোনার), বেড ভাড়া ও ওষুধ খরচ। এর চেয়ে কম খরচে দেশের বেসরকারি কোনো হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। আর পাশের দেশ ভারতেও কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য খরচ হয় ১৫ লাখ টাকার বেশি। শুধু প্রতিস্থাপন নয়, সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও তুলনামূলক কম।এই দেশে কিডনী সংক্রান্ত জটিলতা বেশ বেশি। সিকেডি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, অধ্যাপক কামরুল ও তার দল এ পর্যন্ত যে ১ হাজার ৪টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে, তার মধ্যে মাত্র ৭টি কিডনি কাজ করেনি। প্রতিস্থাপনের পর বিকল হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। অর্থাৎ সফলতার হার ৯৬ শতাংশ। শুনলে ভালো লাগে করোনা মহামারির মধ্যে দেশের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসসহ কিডনি রোগীদের সেবা কার্যক্রমগুলো যখন বন্ধ ছিল, তখনও সিকেডি হাসপাতাল তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে ৪টি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। রোগীদের ফলোআপ পরীক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ ও রিপোর্ট দেখার ফিও নেওয়া হয় না তাঁর হাসপাতালে। এ ছাড়া, খরচ কমাতে কিডনি সংরক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা এক ধরনের দামি তরলের বিকল্প তৈরি করেছেন তিনি। এভাবে নিজ পেশার মাধ্যমে সমাজের নিম্নআয়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছেন এই অধ্যাপক। আগেই বলেছি অনেক প্রবাসী কিডনী রোগে আক্রান্ত হন বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে। এর একটা বড় কারণ খুব সস্তা বলে প্রচুর মাংস। খাওয়া, ১৮-২০ ঘন্টা কাজ করতে গিয়ে বাথরুম চেপে রাখা। সমস্যা সমাধানে পরিমিত পানি ও সুষম খাবার গ্রহণ করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ খাবেন না। কয়েক বছরে পরপর কিডনি পরীক্ষা কররুন। সুস্থভাবে বাঁচুন।আরেকটা কথা। আমরা অনেকেই ভাবি কোটি টাকা, বাড়ি গাড়ি দেশ ছাড়াতেই সব সাফল্য। আজকাল মোটিভেশন মানেই এসব। এই পথে চলে ডাক্তার কামরুল চাইলে কোটি কোটি টাকা আয় করতে পারতেন। কিন্তু সেদিকে তাঁর নজর নেই। তাঁর নজর মানুষের দিকে। মানবদরদী এই চিকিৎসকের মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘একটা মানুষের চলার জন্য খুব বেশি পয়সা তো লাগে না। যে সম্মান আমি পেয়েছি, মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, এটাই তো অমূল্য। এটা তো আর টাকা দিয়ে পাওয়া যাবে না।’আজকের সকালে ডাক্তার কামরুল ইসলামকে স্যালুট। ভালোবাসা। শুভ সকাল আপনাকে। শুভ সকাল সবাইকে। শুভ সকাল বাংলাদেশ।