শরিফুল হাসান

জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। শীতের সকাল। কুয়াশার আবরণ ভেদ করে সূর্য কেবল উঁকি দিচ্ছে আকাশে। এর মধ্যে সবাই পৌঁছে গেছে স্কুলে। সাবিহা, নমিতা, কবীর, সুবীর সবাই। হাসান স্যার তো আগেই এসে গেছেন। সবাই যাবে শিক্ষাসফরে। ঐতিহাসিক সোনারগাঁও যাবে তারা।
এটা চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ের ‘ঘুরে আসি সোনারগাঁও’ শীর্ষক গল্পের অংশ। কিন্তু সব স্কুলের ছেলেমেয়েদের পক্ষে কি এভাবে শিক্ষাসফর বা বনভোজন করা সম্ভব? মাসখানেক আগে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন ৩৫তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ শামীমা আক্তার জাহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান থেকে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর করে এই নারী বিসিএস পরীক্ষা দেন। গত বছর ফল প্রকাশ করলে দেখা যায়, তিনি প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু চাকরিতে যোগ দিতে আরও কয়েক মাস যে বাকি। এর মধ্যেই তিনি বাচ্চাদের স্কুলে পড়নোর জন্য ‘টিচ ফর বাংলাদেশ’-এ একটা ফেলোশিপের জন্য আবেদন করেন। তাতে সুযোগ পেলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার নেতৃত্ব এবং স্কুল উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হন। এরই অংশ হিসেবে তাঁকে কাজীপাড়ার হাজী ইউসুফ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শামীমা বলেন, ‘আমি চতুর্থ শ্রেণিতে “ঘুরে আসি সোনারগাঁও” গল্পটা পড়াতে গিয়ে দেখি, বাচ্চারা শিক্ষাসফরটা ঠিক ভালো করে বোঝে না। আবার সোনারগাঁও দেখেনি বলে নানা প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে পায় না। এর আগে আমার এক বড় ভাই অবশ্য এই বাচ্চাদের নিয়ে দেখিয়ে এনেছিলেন চিড়িয়াখানা। কিন্তু এদের ঢাকার বাইরে শিক্ষাসফরে কাউকে নেওয়ার অভিজ্ঞতাটা সেভাবে নেই। আবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন যারা পড়ে, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র। আমার স্কুলে যারা পড়ে, তাদের মায়েরা গার্মেন্টসে কাজ করেন। তাদের নিজের টাকায় বনভোজন বা শিক্ষাসফর করাটাও কষ্টের। কিন্তু তারপরও ভাবলাম যদি কোনোভাবে তাদের শিক্ষাসফরে নেওয়া যেত। কিন্তু টাকা আসবে কীভাবে? আমি কি পারব গল্পের হাসান স্যারের মতো ম্যাপ দেখিয়ে সোনারগাঁও চেনাতে? ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বললে তারা ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বলল যেতে চায়। কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে? সোনারগাঁওয়ে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে নিয়ে যেতে হলে বাসভাড়া, খাওয়াদাওয়াসহ আছে নানা খরচ। একেকজনের জন্য গড়ে ২৫০ টাকা খরচ ধরলেও ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাগবে। কোথা থেকে আসবে?’
শামীমা বলেন, ‘আমার সঙ্গে এই স্কুলে পড়াত শুভেন্দুও। ওকেও বললাম। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এদের নেবই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটিতে যুক্ত ছিলাম। অনেক বন্ধু, বড় ভাই ফেসবুকে আছেন। হঠাৎ মনে হলো ফেসবুকের বন্ধুদের সাহায্য চাই। ১ জানুয়ারি আমি আমার ইচ্ছের কথা লিখলাম। বললাম, আমি আমার বাচ্চাদের স্বপ্নপূরণে আপনাদের সহায়তা চাই। এরপর বন্ধুবান্ধব আর বড় ভাইবোনদের কাছে অভূতপূর্ব সাড়া পেলাম। টাকা জোগাড় হলো। থানা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিলাম। সবার সহযোগিতায় ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার আমার ৮০ জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে শিক্ষাসফর করে এলাম।’
কেমন লেগেছে ঘুরতে? গতকাল শিক্ষাসফর ঘুরে আসা মুনিয়া ইসলাম, পারভীন আক্তার, আজিজুল হাওলাদারসহ প্রত্যেকেই উচ্ছ্বসিত। বিষয়টা নিয়ে জানতে চাইলে হাজী ইউসুফ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুস্তারি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বাচ্চাদের শিক্ষাসফরে নেওয়ার জন্য আমার কিছু করতে হয়নি। স্কুল থেকেও কোনো খরচ করতে হয়নি। ওরাই সব উদ্যোগ নিয়েছে। আমি চাই, সবাই এ ধরনের ভালো কাজে যুক্ত হোক।’