শরিফুল হাসান

বাংলাদেশে শিশুদের ওপর সহিংসতা বেড়েই চলেছে। গত চার বছরে দেশে ১ হাজার ৮৫টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আর এ বছরের জানুয়ারিতেই হত্যা করা হয়েছে ২৯টি শিশুকে। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলো কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহ। অপহরণের পর তাকে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে দিনাজপুরের মিমি, সিলেটের সালমান ও যশোরের লিমা খাতুনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকেরা বলছেন, পারিবারিক কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, ব্যক্তিগত লোভ-লালসা কিংবা স্বার্থ আদায় করার জন্য দুর্বৃত্তরা একটি পরিবারের সবচেয়ে ভালোবাসার ধন শিশুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।
পুলিশের ওয়েবসাইটে দেওয়া অপরাধের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংখ্যার দিক থেকে মাদকের পর দেশে সবচেয়ে বেশি অপরাধ ঘটে শিশু ও নারী নির্যাতনের। ২০১৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের ২১ হাজার ২২০টি ঘটনা ঘটেছে। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ২৯১টি।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এতগুলো শিশুর মৃত্যু খুবই মর্মান্তিক, দুঃখজনক। অপরাধীরা শিশুদের টার্গেট করছে। ব্যক্তিগত আক্রোশ, জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব, পারিবারিক কলহের শিকার হচ্ছে শিশুরা।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এত বেশি পুলিশ নেই যে সব জায়গায় নজরদারি করা সম্ভব। তবে ঘটনা ঘটলেই পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
শিশু হত্যা ও নির্যাতন এবং তাদের অধিকারের বিষয়গুলোর তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম। আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে শুরু করে বাংলাদেশের শীর্ষ ২৬৭টি বেসরকারি সংস্থা এ ফোরামের সদস্য। ফোরামের গত চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে দেশে ৩ হাজার ৮৯৩টি শিশুর অপমৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৯২টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ৩৬৬টি, ২০১৩ সালে ২১৮টি ও ২০১২ সালে ২০৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তথ্যের উৎস সম্পর্কে ফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ১০টি জাতীয় দৈনিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। তবে গত জানুয়ারি মাসের তথ্য এখনো খসড়া পর্যায়ে আছে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘শিশুরা দুর্বল বলে তাদের ওপর আঘাত করা সহজ। আর আমাদের সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে বাড়ছে। ফলে শিশু নির্যাতন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। শিশু নির্যাতন বন্ধে ২০১৩ সালে শিশু অধিকার আইন করা হলেও এখনো বিধি করা হয়নি। আইনের প্রয়োগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কার্যকর ভূমিকা পালন করে না। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।’
গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল সিলেটের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন ও খুলনার মোহাম্মদ রাকিব হত্যা। দেশের সচেতন মানুষ এ ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামলে দ্রুত এ মামলা দুটির নিষ্পত্তি হয়। রাজন হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি কামরুলসহ চারজনকে ফাঁসি ও সাতজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং রাকিব হত্যা মামলায় দুজনকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। তবে এরপরও এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ‘দেশে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছেই। সরকার হয়তো বলবে শিশু রাকিব ও রাজন হত্যার বিচার হয়েছে। সেটা হয়েছে জনগণের চাপ ছিল বলে। একটা দেশের বিচার তো চাপের মুখে হলে হবে না। তাহলে অপরাধীদের চাপ বেশি থাকলে তারা পার পেয়ে যাবে। কাজেই অপরাধ বন্ধ করতে হলে বিচারকে নিজস্ব গতিতে চলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও দক্ষতা-যোগ্যতার অভাব আছে। তারা স্বাধীনভাবেও কাজ করতে পারছে না। আবার সামাজিকভাবেও অবক্ষয় ঘটেছে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এগুলো মোকাবিলা করতে হবে।’
এ বছরের ৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপায় পারিবারিক কলহের জের ধরে ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি নিজের ভাই ও বোনের তিন সন্তান শিবলু, আমিন ও মাহিনকে পুড়িয়ে হত্যা করে। পরে ইকবালকে প্রতিবেশীরা আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ জানিয়েছে, ইকবাল সিঙ্গাপুরে থাকতেন। সিঙ্গাপুর থেকে ভাই দেলোয়ারের কাছে তিনি টাকা পাঠাতেন। দেশে এসে এই টাকা ফেরত চান তিনি। দেলোয়ার টাকা না দেওয়ায় তিনি তিন শিশুকে হত্যা করেন।
গত ৫ জানুয়ারি এক দিনেই দেশে ছয় শিশুকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে গাজীপুরের টঙ্গীতে চোর সন্দেহে মোজাম্মেলক হককে (১৩) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকায় রানা নামের এক শিশুকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেন তার সৎবাবা। আর চট্টগ্রামে ছুরিকাঘাতে নিহত হয় আজিম হোসেন। সিলেট ও যশোরে অপহরণের পর সালমান ও লিমাকে হত্যা করা হয়। নিখোঁজের এক মাস পর গাজীপুরে ৯ জানুয়ারি রাব্বি হোসেন নামের তিন বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। একইভাবে নিখোঁজের পর কুমিল্লার তাহমিনা ও মনিকা, গাইবান্ধার মশিউর (১১), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লায়লা হোসেন ও তাসলিমা বেগম, নাটোরের খানজাহান ও নরসিংদীর তাপস বিশ্বাসের লাশ উদ্ধার করা হয়।
রাজধানীর রামপুরা এলাকার গৃহকর্মী মুন্নী আক্তারকে (১৩) পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ জানুয়ারি পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। গত ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ২ নম্বর বাবুরাইলে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে শান্ত (৫) ও সুমাইয়া (৫) নামের দুই শিশুও ছিল। ১৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের রামুর বড়বিল গ্রামের একটি ফলের বাগান থেকে মোহাম্মদ শাকিল (১০) ও মোহাম্মদ কাজল (৯) নামের দুই সহোদরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পর ২৮ জানুয়ারি মিঠাপুকুরের একটি জমির গর্ত খুঁড়ে পুলিশ শিশু রাহিমুল ইসলামের (১১) লাশ উদ্ধার করে। ৩০ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ সদরের মালির পাথর এলাকার একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে নীরব (১১) নামের এক মাদ্রাসাছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ বছর এবং অতীতের হত্যার ধরন থেকে দেখা গেছে, অপহরণের পর শিশু হত্যার প্রবণতা বেড়েছে। ২০১৪ সালে অপহরণের পর ৫২টি শিশুকে হত্যা করা হয়। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১৯। গত বছর অপহরণের পর ১০টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের লোভ, জায়গাজমি নিয়ে শত্রুতাসহ নানা কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে। তাই সমস্যা সমাধানে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা দরকার।
কেবল হত্যা নয়, দেশে শিশু ধর্ষণের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। ২০১২ সালে ৮৫টি, ২০১৩ সালে ১৫০টি, ২০১৪ সালে ১৯৯টি এবং ২০১৫ সালে ৫২১টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া অর্ধশত শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আর গত চার বছরে হাজার খানেক শিশু নানাভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
নির্যাতিত শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শ দিচ্ছে সরকারের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলো (ওসিসি)। এ পর্যন্ত সেখানে সাত হাজার নির্যাতিত শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, একটি শিশুকে অপহরণ করলে খুব সহজেই দাবি আদায় করা সম্ভব—এমন ভাবনা থেকে শিশু অপহরণ বা হত্যা হয়ে থাকে। এ সমস্যা সমাধানে অপরাধ কমাতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। আর দেশে শিশুশ্রম আছে বলে সেখানেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সবার সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান করা কঠিন।