শরিফুল হাসান
২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের একাদশ শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যবইটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। বইটির প্রচ্ছদে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) লোগো আছে। পেছনে লেখা, ‘সৃজনশীল ২০১০ সংশোধিত ও পরিমার্জিত’। কিন্তু এনসিটিবি বলছে, তারা এ বছর এমন কোনো বই বের করেনি।বাজারে উচ্চমাধ্যমিক বাংলা সংকলন নামে ১৬৪ পৃষ্ঠার সৃজনশীল পদ্ধতির যে বইটি পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম ৫৬ টাকা। এনসিটিবি বলছে, একশ্রেণীর অসাধু প্রকাশক নকল এ বইটি বের করেছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সৃজনশীল পদ্ধতির ‘উচ্চমাধ্যমিক বাংলা সংকলন’ বাজারে আসবে। তবে সেটি নতুন বই হবে না। গত বছরের বইয়ের সঙ্গে সৃজনশীল অংশটি (ডিউ পার্ট) কেবল জুড়ে দেওয়া হবে। বাজারে যে বইটি পাওয়া যাচ্ছে, সে বইয়ের সঙ্গে এ বইয়ের সৃজনশীল অংশের কোনো মিলই থাকবে না।জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর বাংলা যে বইটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, তা বোর্ডের নয়। তিনি জানান, এনসিটিবি যে বই বের করবে, তার সৃজনশীল অংশের মুদ্রণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে সেটি চূড়ান্ত হয়েছে।অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনসিটিবির একশ্রেণীর অসাধু কর্মচারীর সহায়তায় নকল বইটি বের হয়েছে। তাঁরা বইটির মূল পাণ্ডুলিপি অসাধু প্রকাশকদের হাতে দেন এবং তা ঢাকা ছাড়াও নোয়াখালী, যশোর, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে ছাপা ও বিক্রি চলছে।সৃজনশীল পদ্ধতির বাংলা বইয়ের প্রকাশনার কাজের সঙ্গে যুক্ত এনসিটিবির বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রতন সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এখন বাজারে সৃজনশীল পদ্ধতির যে নতুন বাংলা বই পাওয়া যাচ্ছে তা ভুয়া।কারা বের করছে এ বই: অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রেতা সমিতির শীর্ষস্থানীয় এক নেতার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নকল বই বের করছেন এম এ হাশেম ওরফে জনি নামের এক ব্যক্তি। জনির সঙ্গে কাজ করছেন তাঁর ভাই আবদুস সালাম ওরফে জাবেদ। তাঁদের সঙ্গে আছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতা এবং কিছু অসাধু প্রকাশক। এ চক্রটিই বাংলাবাজারে খুবই শক্তিশালী। তাঁরা বাংলাবাজারের বিভিন্ন ছাপাখানায় গিয়ে নকল বই ছাপতে বাধ্য করেন।বাংলাবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘বই প্রকাশনী’র স্বত্বাধিকারীর নাতি পরিচয়ে নকল বই বের করছেন জনি ও জাবেদ। এ বছর বই প্রকাশনী ‘অনন্যা সৃজনশীল উচ্চমাধ্যমিক বাংলা’ নামের একটি গাইড বই বের করেছে। মূল বই বের হওয়ার আগে গাইড বই বের হওয়া এবং তাতে সৃজনশীল প্রশ্ন হুবহু মিলে যাওয়ায় ওই প্রকাশনী ঘিরে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।বই প্রকাশের ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে এটা মিলল, সেটি বলতে পারব না।’এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাবেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেবল আমরা নই, অনেকেই এ কাজের সঙ্গে জড়িত। অন্তত ৪০-৫০ জন এই জালিয়াতির কাজে যুক্ত। কাজেই সব দোষ আমাদের দিয়ে লাভ কী?’সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নকল বইয়ের বিষয়টি তাঁদের জানা নেই।জানা যায়, বাংলাবাজার ছাড়াও চক্রটির সঙ্গে নোয়াখালী, বগুড়া ও যশোরের কিছু অসাধু প্রকাশক ও গ্রন্থাগারিক জড়িত।নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কয়েকজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, এনসিটিবি নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে বই ছাড়তে পারে না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নকল বই বাজারে ছাড়েন কিছু অসাধু প্রকাশক। এ ক্ষেত্রে এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরও যোগসাজশ থাকে।তবে এনসিটিবিরি চেয়ারম্যান বলেন, বোর্ডের কেউ জড়িত কি না, তা তিনি জানেন না।ভুলে ভরা নকল বই: বাজরে যে নকল বইটি পাওয়া যাচ্ছে, সেটি নিম্নমানের নিউজ প্রিন্ট কাগজে ছাপা। অসংখ্য বানান ভুল, অসংগতিপূর্ণ তথ্য, নেই দাঁড়ি-কমার যথার্থ ব্যবহার। অনেক জায়গায় ছাপা পরিষ্কার নয়, আবার কোনো কোনো জায়গায় কালি পড়েছে বেশি। প্রত্যেক গল্প ও কবিতার শেষে আলাদা সৃজনশীল প্রশ্ন জুড়ে দেওয়া হয়েছে।বইটিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আবু জাফর শামসুদ্দীন ও হুমায়ূন আহমেদের নামের বানান ভুল ছাপা হয়েছে।৯৬ পৃষ্ঠায় আছে এইডস নিয়ে লেখা হুমায়ূন আহমেদের ‘অপরাহ্নের গল্প’। গল্পের শেষ লাইন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে “সেভ দি চিলড্রেন”-এর ব্যবস্থাপনায় ও গ্লোবাল ফান্ডের অর্থায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রকল্প পায়াখট, বাংলাদেশের অধীন এইডস বিষয়ে প্রণীত জীবন দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলাম অনুসারে রচিত।’আসলে এটি হুমায়ূন আহমেদের রচনার লাইন নয়। এটি রচনার গোলমেলে পটভূমি।বইয়ের ১৪০ পৃষ্ঠায় আছে সুফিয়া কামালের কবিতা ‘তাহারেই পড়ে মনে’। কবিতার শেষে লেখা হয়েছে, ‘তাহেরই পড়ে মনে’, আবার কোথাও লেখা আছে ‘তাহাইে পড়ে মনে’। এ ছাড়া দুর্নীতির জায়গায় ‘দুনীতি’, ধারণাকে ‘ধাননা’, প্রদানকে ‘প্রধান’, উল্লেখযোগ্যকে ‘উলেখযোগ্য’, নয়াদিল্লিকে ‘নয়াদিলি’ লেখা হয়েছে।প্রতারিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা: কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেছে, পাঠ্যবই যে নকল হতে পারে, এটা তাদের ধারণায়ও নেই। এ বছর তাদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। কাজেই বাজারে এনসিটিবির নাম লেখা দেখেই তারা বই কিনেছে।নটর ডেম কলেজের ছাত্র তালহা মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলে, সে নীলক্ষেত থেকে সৃজনশীল পদ্ধতির নতুন বাংলা বইটি কিনেছে। তার অনেক সহপাঠীও বইটি কিনেছে।