শরিফুল হাসান
সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪। এর মধ্যে অন্তত পাঁচজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী যারা আগুন নিয়ন্ত্রণে গিয়েছিল। এই পাঁচ বীরকে সালাম। ফায়ার সার্ভিসের আরো অন্তত ১৫ জন নানা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ভয়াবহ এই আগুনে ডিপোর শ্রমিক, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ অন্তত দেড় শতাধিক অগ্নিদগ্ধ। অনেক রক্ত দরকার হচ্ছে। বার্ণ রোগী বলে অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন। চট্টগ্রামের সব চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন। সরকারসহ নীতি নির্ধারকরা নিশ্চয়ই নজরদারি করছেন। তারপরও বলছি, আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে নামা উচিত।
প্রয়োজনে সশস্ত্রবাহিনীকে যুক্ত করার কথা লিখেছলাম। ইতিমধ্যে দেখছি সেনাবাহিনী যুক্ত হয়েছে। দরকার হলে ঢাকা থেকে জরুরি টিম যাক। অনেক অনেক ডাক্তার নার্স দরকার। এম্বুলেন্স ওষুধপত্রসহ যা যা লাগবে দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে।
হেলিকপ্টার দিয়ে ঢাকায় রোগী আনতে হবে প্রয়োজনে। আমি মনে করি প্রাথমিকভাবে যেভাবে সবাই এগিয়ে এসেছেন সেটা আমাদের সম্মিলিত শক্তির পরিচয় দেয়। আমাদের এভাবেই এখন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বিস্ফোরণের যেসব ছবি ও খবর দেখছি তাতে বুকটা কেঁপে উঠছে। হে আল্লাহ রহম করো!

মনিরুজ্জামান, মহিউদ্দীন, হাবিবুর রহমান, রবিউল আলম, নিপুন চাকমা, প্রতেককে স্যালুট। সীতাকুন্ডে কন্টেইনারের ডিপোর আগুন নেভাতে গিয়ে তারাসহ মোট আটজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীর জীবন গেছে। আরো অন্তত ২১ জন হাসপাতালে। তারা সবাই আগুন নিয়ন্ত্রণে গিয়ে আহত।
অথচ সেখানে যে বিপুল পরিমান রাসায়নিক আছে সেটা তাদের জানানোই হয়নি। কোন একটা ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের এতোগুলো মানুষের মৃৃত্যু আগে হয়েছে কী না আমার জানা নেই। এই মানুষগুলোকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি একটা ঘটনা স্মরণ করে। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ। মেঘনায় এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চ ডুবেছে। শত শত মানুষ নিখোঁজ। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমে বসে মানুষের আহাজারি দেখছি আর খবর পাঠাচ্ছি। ঘটনার দুদিন পর স্বজনেরা জীবিত নয়, লাশের জন্য আহাজারি করছে।
বিভিন্ন সংস্থার দেশি-বিদেশি ট্রেনিং পাওয়া লোকজন আসছে আধুনিক সব সরঞ্জাম নিয়ে। তারা পানির নিচে যায়। কিন্তু লাশ পায় না। ওই সময়ে হাজির হলেন লিকলিকে শরীরের ফায়ার সার্ভিসের এক ডুবুরি। তিনি একেকটা ডুব দেন। দুইটা করে লাশ তোলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে একাই ৩০-৩৫ টা লাশ তুললেন। সব বাহিনীর সদস্যরা বিস্ময় নিয়ে তাকে দেখছিলো। লোকটার নাম আবুল খায়ের। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি। অসম্ভব সাহসী এক মানুষ। প্রচণ্ড স্রোত বা যতো প্রতিকূল পরিস্থিতি হোক, ডাক পড়ে এই খায়েরের। সিনিয়র অফিসাররা জানতে চায়, আবুল খায়ের, তুমি কি যেতে পারবে?’ তাঁর উত্তর, ‘পারব স্যার। কিন্তু ফিরে আসতে পারব, সে আশা নাই।
আমি মারা গেলে স্যার লাশটা বাড়িতে পাঠায় দিয়েন।’এই আবুল খায়েরকে আবার পেয়েছিলাম ২০১৩ সালে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরের উদ্ধারকাজে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ইউসুফ, রব, সোহেল রানাসহ আরো অনেক ফায়ার কর্মী। প্রত্যেকই যেন বীর। প্রায় দুই দশকের সাংবাদিকতা জীবনে রানা প্লাজায় ভবন ধ্বস, লঞ্চডুবি, তাজরীন, নিমতলীর আগুন সবই দেখেছি। একদল লোকের দুর্নীতি ক্ষমতা আর লোভের বলি হন আমাদের সাধারণ মানুষ। বারবার ঘটে দুর্ঘটনা।

আর প্রতিটা দু্ঘটায় দেখেছি ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কী অসাধারণ কাজ করে। বাংলাদেশে আরো অনেক বাহিনী আছে। সবাই কম-বেশি কাজ করে। কিন্তু আমার সবসময় মনে হয়েছে, ফায়ার সার্ভিস অসাধারণ এক বাহিনী। সীতাকুণ্ডে প্রাণ দিয়ে, আহত হয়ে তারা অবারও সেটা প্রমাণ করলেন। আমি মনে করি নিহত ও আহত প্রতিটা পরিবারের পাশে রাষ্ট্রের দাঁড়ানো দরকার। দরকার আমাদের সবার দাঁড়ানো। চট্টগ্রামে গত শনিবার রাতের ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় ৩৮ জন মানুষ মারা গেছেন।
শতাধিক মানুষ হাসপাতালে। সকাল থেকে হতাহতদের ছবিগুলো দেখছি, খবর পড়ছি আর কাঁদছি। দেখেন চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের ১৮৩ জন সদস্য আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবুও পারছেন না। আসলে এখানে যে কেমিকেল ছিলো তারা সেটা জানতেই পারেনি। তার মানে আমার তাদের হত্যা করেছি। তবু দেখেন এই বীরেরা এখনো কাজ করছে। আফসোসটা কী জানেন! এই দেশে একদল লোক দুর্নীতি আর অনিয়ম করে আর ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ। এই দেশের প্রায় প্রত্যেকটা দুর্ঘটনার পেছনে তদারককারীদের অবহেলা আর ক্ষমতাশালীদের দুর্নীতি বা অনিয়মের চিত্র মিলবে।
তবে আগুন লাগুক, লঞ্চডুবি বা যে কোন দুর্যোগ, সবার আগে ফায়ার সার্ভিস হাজির। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা সদস্য যে সাহস আর মনোবল নিয়ে কাজ করেন তাতে তাদের আমি বলি আনসাং হিরো।ভালোবাসা ফায়ার সার্ভিসের জন্য। এই বাহিনীর প্রতিটা সদস্যকে স্যালুট।

স্যালুট সব উদ্ধারকর্মীদের যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। স্যালুট ডাক্তার, স্বেচ্ছাসেবক, রক্তদাতাসহ প্রতিটা মানুষকে যারা এই কন্টেইনার ডিপোর উদ্ধারকাজ ও আহতদের সেবায় কাজ করছেন। আল্লাহ আমাদের রহম করুন। রহম করুন এই দেশকে!
সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে এতো বিপুল পরিমান রাসায়নিক ছিলো সেটা কেন ফায়ার সার্ভিসকে আগে জানানা হয়নি? ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে নিহতদের মধ্যে ৬ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। আরো অন্তত ২১ জন হাসপাতালে।
তারা সবাই আগুন নিয়ন্ত্রণে গিয়ে জীবন দিল। অথচ সেখানে যে বিপুল পরিমান রাসায়নিক আছে সেটা তাদের জানানোই হয়নি। একবার ভাবেন, গতরাতে আগুন লাগলো, আজকে সারাটা দিন পেরুতে চললো অথচ এখনো মালিকপক্ষকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের আজ বলেছেন, ডিপোতে কী ধরনের কেমিক্যাল আছে বলা যাচ্ছে না। পানি দিয়ে সব কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে।
এ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৬ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছেন।গত শনিবার রাতের ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় ৩৮ জন মানুষ মারা গেছেন। শতাধিক মানুষ হাসপাতালে। সকাল থেকে হতাহতদের ছবিগুলো দেখছি, খবর পড়ছি আর কাঁদছি। দেখেন চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের ১৮৩ জন সদস্য আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবুও পারছেন না।
আসলে এখানে যে কেমিকেল ছিলো তারা সেটা জানতেই পারেনি। ফলে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে কেমিক্যালের এই আগুন ছড়িয়েছে আড়াই বর্গকিলোমিটারজুড়ে।একটা বিষয় না বললেই নয়। এই দেশে আগুন বলেন, লঞ্চডুবি কিংবা যে কোন দুর্ঘটনা! এখানে নানা পক্ষের যথেষ্ট গাফিলতি থাকে।
আর থাকে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা যার বলে অনিয়ম হয় দুর্নীতি হয় কিন্তু তদারকির দায়িত্বে থাকা কেউ দুর্ঘটনার আগে দেখে না। আচ্ছা বলেন তো এই ডিপোতে কী নজরদারির জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ ছিলো না? থাকলে তারা কী দায়িত্ব পালন করেছে? এটা কী শুধুই দুর্ঘটনা? অবশ্য এখন দেখবেন তদন্ত কমিটি হবে। নানা কিছু বের হবে। কিন্তু বারবারই কেন দুর্ঘটনা আর প্রাণহানির পর এগুলো বের হয়?আচ্ছা আর কতোদিন এভাবে চলবে? সাংবাদিক হিসেবে গত দুই দশকে কতো দুর্ঘটনা আর কতো যে লাশ দেখেছি! ভীষণ কষ্ট লাগে।
আচ্ছা স্বজন হারাদের এই আর্তনাদ আর কতোকাল চলবে? আমি যে বারবার দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করে সুশাসন আর জবাবদিহিতার কথা বলে এই কারণেই বলি। এই দেশের প্রত্যেকটা দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর কারণ খুঁজুন।
দেখবেন অনিয়ম, দুর্নীতিসহ তদারককারী কর্তৃপক্ষের অবহেলা পদে পদে। আচ্ছা এই দেশে আর কতো মানুষ মরলে আমাদের হুশ হবে? আর ঠিক কতো মানুষ মরলে আমাদের মনে হবে অনেক হয়েছে, এবার সবকিছু ঠিক করি। আর কতো?

দুর্ঘটনায় ৫০ জন মানুষ মরে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদপ্তর আজ বলছে, সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক মজুতের অনুমোদন বা অনুমতি ছিল না।
চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন এই তথ্য জানিয়ে বলেছেন, ‘ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বা যেকোনো রাসায়নিক মজুতের জন্য লাইসেন্স কিংবা কোনো ধরনের অনুমতি নেয়নি ডিপো কর্তৃপক্ষ। এমনকি এ বিষয়ে পরিদপ্তরকে কোনো কিছু জানানোও হয়নি।
কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই ডিপোতে রাসায়নিক মজুত করেছিল তারা।’সকালেই লিখেছি দুর্ঘটনার পর এমন কিছুই শুনবেন। এই যে অনুমোদন ছিলো না সেটা এই রাষ্ট্রের নানা দপ্তরের কেউ জানতে পারেননি? বিস্ফোরক অধিদপ্তর এতদিন কি করেছে? এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তো ঘুষ নেয়ার অভিযোগ কমবেশি বহুদিন ধরে শুনছি? আচ্ছা তদারকি কর্তৃপক্ষ হিসেবে আপনাদের দায় কী?
প্রশাসন এতোদিন কোন ব্যবস্থা নেয়নি কেন? আচ্ছা বলেন তো এই ডিপোতে কী নজরদারির জন্য সরকারি কোন কর্তৃপক্ষ ছিলো না? থাকলে তারা কী দায়িত্ব পালন করেছে? এটা কী শুধুই দুর্ঘটনা? এই যে ডিপো কর্তৃপক্ষ কাউকে জানায়নি এমনকি ডিপোতে যে বিপুল পরিমান রাসায়নিক ছিলো সেটাও ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি তার শাস্তি কী? এই যে ফায়ার সার্ভিসের আটজন কর্মীকে মরতে হলো, আরো অন্তত ২১ জন হাসপাতালে, সব মিলিয়ে অর্ধশত মৃত্যু এর দায় কার? জানি না এসব প্রশ্নের কেন উত্তর নেই। আসলে এ এক বিস্ময়কর দেশ!

এই দেশে লঞ্চ ডুবলে ঘটনার পর জানা যায় লঞ্চে ত্রুটি ছিল। ভবনে আগুন লাগলে জানা যায় যথাযথ অনুমোদন নেই। বাস দুর্ঘটনার পর জানা যায় ফিটনেস নেই। মাতালের মতো গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যার পর জানা যায় লাইসেন্স নেই। অথচ এসব তদারকের দায়িত্বে নানা কর্তৃপক্ষ আছে! কিন্তু মানুষ মরে যাওয়ার আগে কারো হুঁশ হয় না। দায়িত্ব অবহেলায় কারো শাস্তি হয় না। তবে প্রতিবারই ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়, নানা আলোচনা হয়, তারপর আমরা ফের অপেক্ষা করি নতুন কোন দুর্ঘটনার!
সাংবাদিক হিসেবে গত দুই দশকে কতো দুর্ঘটনা আর কতো যে লাশ দেখেছি! ভীষণ কষ্ট লাগে। আমি যে বারবার দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করে সুশাসন আর জবাবদিহিতার কথা বলে এই কারণেই বলি। এই দেশের প্রত্যেকটা দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর কারণ খুঁজুন। দেখবেন অনিয়ম, দুর্নীতিসহ তদারককারী কর্তৃপক্ষের অবহেলা পদে পদে।
আচ্ছা স্বাধীনতার ৫০ বছর তো হলো। এভাবে আর কতদিন চলবে? এ কারণেই সকালে লিখেছি, স্বজন হারাদের এই আর্তনাদ আর কতোকাল চলবে? আর কতো মানুষ মরলে আমাদের হুশ হবে? আর কতো?