সিটি করপোরেশন নির্বাচন

Spread the love

আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের বিপরীতে বিএনপির তৈমুর

শরিফুল হাসান 


নারায়ণগঞ্জে বিএনপির দলীয় কোন্দল বেশ পুরোনো। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে এই দ্বন্দ্ব দূর করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। স্থানীয় নেতারাও বলছেন, কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে দূরে ঠেলে রাখা হয়েছে সব মতবিরোধ। এখন একক প্রার্থী জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকারকে নিয়ে এগোচ্ছেন তাঁরা। ‘গডফাদার’ তকমা নিয়ে দীর্ঘ সাত বছর ‘দেশছাড়া’ থাকার পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান। এখন প্রতিনিয়তই তিনি খবর হচ্ছেন দলীয় সাংসদ সারাহ্ বেগম কবরীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে। তাঁর কর্মকাণ্ডে আবার অস্থির নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ। নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থায় সদ্য সিটি করপোরেশন ঘোষিত নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী হতে চান শামীম ওসমান। আর সদ্য বিলুপ্ত পৌরসভার সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীও চান আওয়ামী লীগের সমর্থন। গতকাল তিনি মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন।আগামী ৩০ অক্টোবর নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ্রসিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শামীম ওসমান নাকি সেলিনা হায়াত আইভীকে প্রার্থী করবে আওয়ামী লীগ—তা-ই এখন এখানকার বড় আলোচ্য বিষয়। আইভী দাবি করেছেন, তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন, এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত। একই দাবি শামীম ওসমানেরও। ফলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভক্তি থাকছে। আর প্রার্থী ঠিক না হওয়া পর্যন্ত ভোটারদের মধ্যে থাকছে অনিশ্চয়তা।নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ্র ও বন্দরের কদমরসুল পৌরসভা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, এই তিন পৌরসভার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ নগর ও বন্দর বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বের কোনো প্রভাব যেন নির্বাচনে না পড়ে, সে জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে জেলার সব নেতা-কর্মীকে ডেকে কয়েক দিন ধরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সর্বশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কেউ কাজ করলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের মতোই এ নির্বাচনেও জয় ছিনিয়ে আনার জন্য নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার ছাড়াও বৈঠকে সাবেক সাংসদ রেজাউল করিম ও আবুল কালাম, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী মনিরুজ্জামান মনির, সহসভাপতি শাহ আলম, শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই বৈঠকের পর আমরা সবাই একজোট হয়ে কাজ করছি। আমাদের মধ্যে এখন বিন্দুমাত্র বিভেদও নেই। আমরা মনে করি, এই ঐক্য কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে আমরা জয়ী হব।’জেলা বিএনপির সভাপতি ও মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটি কারণে আমরা মনে করছি আগামী নির্বাচনে আমরা অবশ্যই জয়ী হব। প্রধান কারণ দ্রব্যমূল্য, সন্ত্রাস, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ সর্বক্ষেত্রে এই সরকারের ব্যর্থতা। আছে জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে ইস্যু। কাজেই মানুষ মুখিয়ে আছে এই সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার জন্য। আর আমার নেতা-কর্মীরাও এখন ঐক্যবদ্ধ। কাজেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আমরা জয়ী হবই।’প্রার্থী জটিলতার কারণে আওয়ামী লীগ এখনো বিভক্ত। এই বিভক্তি কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ সব অঙ্গসহযোগী সংগঠনের মধ্যে। জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এস এম আকরাম, নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সহসভাপতি শেখ হায়দার আলী,্র জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক নাজিমউদ্দিন নাজিম, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনউদ্দিন মাহমুদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জি এম আরাফাতসহ নেতাদের একটি অংশ আইভীর পক্ষে।শামীম ওসমানের পক্ষ্রেআছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনিসুর রহমান, ওয়াজেদ আলীসহ সংগঠনের আরেকটি অংশ।আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, শামীম ওসমান বা আইভী যিনিই কেন্দ্রের মনোনয়ন পান না কেন, এই নির্বাচনে দলের বিভক্তি কাটছে না। শামীম ওসমান অবশ্য গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের মধ্যে বিভক্তি থাকলে এর প্রভাব নির্বাচনে পড়বে এবং প্রতিপক্ষ লাভবান হবে। কাজেই এই বিরোধ দূর করা উচিত।’ এ ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দল যদি আমাকে মনোনয়ন না দেয়, তাহলে যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, আমি তাঁর পক্ষেই কাজ করব।’সাবেক মেয়র আইভীর পক্ষের নেতা-কর্মীরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ আগামী নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভীকেই মেয়র হিসেবে দেখতে চায়। কারণ, ২০০৩ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি নির্বাচন করে পৌরসভার মেয়র হয়েছেন। গত আট বছরে তিনি অনেক উন্নয়নকাজ করেছেন। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার অনেক কিছুই বদলে দিয়েছেন তিনি। তাই দলের উচিত অবশ্যই তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া।জানতে চাইলে সেলিনা হায়াত আইভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জে যে উন্নয়ন করেছি, তা এখানকার মানুষ ও আমার দল জানে। তাই দল আমাকে অবশ্যই মনোনয়ন দেবে বলেই আমি মনে করছি।’ মনোনয়ন না দিলে কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে মনোনয়ন না দেওয়ার কোনো কারণ নেই।’জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দল থেকে একজনকেই সমর্থন দেব। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর আলোচনা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’সংলাপে যাননি দুই প্রার্থী: সম্ভাব্য তিনজন মেয়র পদপ্রার্থীকে নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন শহরের চাষাঢ়া এলাকায় সরকারি মহিলা কলেজ মাঠে গতকাল মুক্ত সংলাপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। শামীম ওসমান সেখানে গেলেও বাকি দুই প্রার্থী সেখানে যাননি। বাকি দুই প্রার্থীর দাবি, তাঁরা নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকায় অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি।তবে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, অনুষ্ঠানস্থলে শামীম ওসমানের লোকজন আগে থেকেই গিয়ে চেয়ার দখল করে রাখে। সেখানে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে কি না—এই আতঙ্কে বাকি দুই প্রার্থী সেখানে যাননি।তবে শামীম ওসমান বাকি দুজনের অনুপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একটি উন্মুক্ত সংলাপে না আসার কোনো কারণ নেই। আমাকে যদি বলা হয়, আইভীর বাসায় সংলাপ, আমি সেখানেও যেতে রাজি।’আচরণবিধি ভঙ্গ:্রগতকাল সোমবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সতর্কীকরণ চিঠি দেওয়া হয়েছে সেলিনা হায়াত আইভীকে। হঠাৎ করে সংবাদ সম্মেলন করার অভিযোগে তাঁকে এই চিঠি দেওয়া হয়। তবে আইভী বলেছেন, তিনি কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রেসক্লাবে গিয়েছিলেন।এর আগে রোববার আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সভা আয়োজনের অভিযোগ এনে শামীম ওসমান ও তৈমুর আলম খন্দকারকেও সতর্কীকরণ চিঠি দেয় কমিশন। তৈমুর আলম খন্দকার অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি কোনো জনসভা না করলেও তাঁকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।শামীম ওসমানের স্ত্রীর সভা বন্ধ: সোমবার সন্ধ্যায় শহরের জামতলায় শামীম ওসমানের সমর্থনে তাঁর স্ত্রী সালমা ওসমান একটি কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। খবর পেয়ে নির্বাচন কমিশন তা বন্ধ করে দেয়।সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে জানান, নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী কোনো সময়ই কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে সভা করা যাবে না।গতকাল সন্ধ্যায় শহরের দেওভোগ শুক্কুর কারী মসজিদের পেছনে সমাবেশ আয়োজন করে শামীম ওসমানের অনুসারী রফিকুল ইসলাম ও তোফাজ্জল হোসেন নামের দুই ব্যক্তি। খবর পেয়ে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহ আলমের নেতৃত্বে সদর মডেল থানার পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১০টি চেয়ার জব্দ করে। ফরহাদ হোসেন জানান, এখন নয়, আগামী ৯ অক্টোবর থেকে প্রার্থীরা পথসভা করতে পারবেন।মনোনয়নপত্র সংগ্রহ: সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থীরা মনোনয়নপত্র কিনতে শুরু করেছেন। সোমবার পর্যন্ত মেয়র পদে চারটি ও কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে দুই শতাধিক মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে।মেয়র পদে মনোনয়নপত্র কিনেছেন তৈমুর আলম খন্দকার, সেলিনা হায়াত আইভী, আওয়ামী ওলামা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বহিষ্কৃত সভাপতি হাবিবুল্লাহ কাঁচপুরী ও শহরের তল্লা এলাকার বাসিন্দা আতিকুল ইসলাম। শামীম ওসমান গতকাল পর্যন্ত মনোনয়নপত্র কেনেননি।ভোটকেন্দ্র যাচাই-বাছাই: রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে জানান, ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করেছে। ২৭টি ওয়ার্ডকে তিন ভাগে ভাগ করে নয়জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও তাঁদের সহযোগীরা ১৬৩টি ভোটকেন্দ্র সরেজমিনে পরিদর্শন করছেন। এসব ভোটকেন্দ্রের অবস্থান, সুবিধা-অসুবিধা চিহ্নিত করা হচ্ছে। শনাক্ত করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলো। এর ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাই। এ জন্য কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার লঙ্ঘন করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর মনোনয়নপত্রও বাতিল হতে পারে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.