শরিফুল হাসান
মৃত্যুর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে! পরপর দুটো মৃত্যুর খবর পেলাম। এর মধ্যে রাজধানীর রায়েরবাজারে ভাড়া বাসা থেকে আজ বুধবার সাংবাদিক সোহানা তুলির (৩৮) মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে— এটি আত্মহত্যা হতে পারে। তবে তারা ঘটনার তদন্ত করছে। একটা সদ্য হাসিমুখে থাকা মানুষ হুট করে নেই হয়ে যাবে ভাবলেই ভীষণ মন খারাপ লাগে। সোহানা তুলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছোটবোন।
সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে লেখাপড়া করে দীর্ঘদিন আমাদের সময়, কালের কণ্ঠসহ অনেক জায়গায কাজ করেছেন। সর্বশেষ বাংলা ট্রিবিউনে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি একটি অনলাইন শপ খুলে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। বিভাগের করিডোর বা পিকনিকে যে কয়বার দেখা হয়েছে আমি তাঁর হাসিমুখ দেখেছি। মনে হয়েছে উচ্ছল একজন মানুষ। এমন একজন মানুষের মরে যাওয়া মানতে কষ্ট হয়।
আচ্ছা এগুলো কী আত্মহত্যা নাকি কোনভাবে হত্যা? আমরা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে নানাভাবেই কী মানুষকে হত্যা করি না? মন খারাপ নিয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম। মন খারাপের আরেকটা কারণ তুলিদের ব্যাচেরই আরেক ছাত্রী মাফরুদা হক সুতপা। ১৩ বছর আগে তাঁর মৃত্যুর খবরটাও আমি লিখেছিলাম।
এ নিয়ে একাধিক ফলোআপ নিউজ করেছিলাম। ২০০৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মিরপুরে স্বামীর বাড়িতে সুতপার মৃত্যু হয়। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম, সুতপাকে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিয়মিত নিপীড়ন করতো। এর জের ধরেই হয়তো আত্মহত্যা করেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছিল মেয়েটিকে আসলে দিনের পর দিন মারধর করে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় পরে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে সুতপার স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। আদালতেও প্রমাণ হয় স্বামীর নির্যাতন মাফরুদাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে।
কিন্তু সুতপার পরিবার কাঙ্খিত বিচার পায়নি। এ নিয়ে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুতপার বন্ধুরা মানবন্ধন করে। হয়তো তুলিও সেই মানবন্ধনে ছিলো। ১৩ বছর পর আজকে সুতপার আরেক বন্ধুর মৃত্যুর খবরটায় মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের আরেক সাবেক ছাত্রী নাঈমা নার্গিস ববি আপার মৃত্যুর খবরটাও শুনলাম। ব্রেইন স্ট্রোক করে ল্যাব এইড হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গেছেন। সেই মৃত্যুটাও ভীষণ বেদনার।
এটাকেও আমার হত্যা মনে হয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (ডিইউএমসিজেএএ) সদস্য ছিলো ববি আপা। কয়েকটা মিটিংয়ে দেখা হয়েছে। নানা ধরনের সামাজিক কাজে যুক্ত ছিলেন। তাঁর বন্ধুদের সূত্রে জানলাম, ববি আপার একটা ছেলে ছিল। দাম্পত্য ভেঙে যাবার পর বাচ্চার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে দিতো না তাঁর প্রাক্তন স্বামী। বাচ্চার সাক্ষাৎ পেতে আদালতের দ্বারস্থ হন ববি আপা। আদালতে শুনানির সময় তার প্রাক্তন পক্ষ হাজিরই হয়নি।
দুদফা ঘটবার পর আদালত সমন দিল। আদালতের সমন কার্যকরের দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু সেটি হয়নি। ওদিকে ববি আপা খবর পান বাচ্চাকে নিয়ে তার প্রাক্তন স্বামী দেশত্যাগ করতে চেষ্টা করছে। তিনি তখন ইমিগ্রেশন পুলিশকে চিঠি লিখেন। ওদিকে গত ২৫শে জুন বাচ্চা নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেন তার প্রাক্তন স্বামী। খবরটা ববি আপাকে জানাতে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। এমনিতে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা ছিল।
বাচ্চা হারানোর আঘাত সামলানো আসলে সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। ব্রেইন স্ট্রোক করে আজ মারা গেলেন। তিনটা ঘটনার মধ্যে আমি এক ধরনের মিল পাচ্ছি। আসলে এই সমাজ, এই রাষ্ট্র এখানকার আইন কানুন নিয়ম প্রথা সবকিছুই একজন নারীর জন্য, একজন সিঙ্গেল মাদারের জন্য ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক!
এই দেশের পথের প্রান্তরে ঘরে বাইরে অফিসে আদালতে নারীদের যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সেটা একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে একটা বড় অংশ ভেতরে ভেতরে ভরে গিয়ে শারীরিকভাবে শুধু কোনমতে বাঁচে। যারা পারে না তারা কেউ কেউ নিজেরা মরে বা তাদের হত্যা করা হয়। জানি না এই যুদ্ধের শেষ কোথায়?
জানি না তুলি, সুতপা, ববিদের মৃত্যু কবে থামবে? জানি না কবে নারী পুরুষ শিশুসহ সব মানুষের জন্য আমরা একটা মানবিক সুন্দর দেশ গড়তে পারবো?