সন্দ্বীপ

Spread the love

শরিফুল হাসান

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন এক দ্বীপ এই সন্দীপ। ইউরোপীয়দের লেখা ইতিহাসে জানা যায় যে সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছরের অধিককাল ধরে লোক বসতি বিদ্যমান। সন্দ্বীপের লবণশিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্রশিল্প পৃথিবীখ্যাত ছিল। সন্দ্বীপ এককালে কম খরচে মজবুত ও সুন্দর জাহাজ নির্মানের জন্য পৃথিবীখ্যাত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এই জাহাজ রপ্তানি করা হতো। তুরস্কের সুলতান এই এলাকার জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এখান থেকে বেশ কিছু জাহাজ কিনে নেন। মোঘল যুগে

১৫৮২ সালে তৎকালীন বঙ্গদেশকে ১৯টি প্রদেশে বিভক্ত করা হলে তাতে মহাল বা পরগনার সংখ্যা ছিল ৬৮২ টি। তন্মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি মহাল বা পরগনা। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, বামনী ও সাগরদিহি নামক দ্বীপ চতুষ্টয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় সন্দ্বীপ পরগনা।ইতিহাস বলছে, ভারতবর্ষের মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর। লবণ ও জাহাজ ব্যবসা, শস্য সম্পদ ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগিজরা সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেন। এছাড়া ভ্রমণ ও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ফরাসি ও ওলোন্দাজ পরিব্রাজকরা প্রায়ই সন্দ্বীপে আগমন করতেন।

১৬১৫ সালে পর্তুগিজদের সাথে আরকান রাজ্যের যুদ্ধে ২০০ জন সৈন্য-সহ পর্তুগিজ সেনাপতি ইমানুয়েল মার্তুস নিহত হযন এবং পর্তুগিজরা সন্দ্বীপ ত্যাগ করলে ১৬১৬ সালে মগরাজ সন্দ্বীপ দখল করে। এরপর সন্দ্বীপে আরকান ও মগদের প্রাধান্য ছিল। মোগল সরকারের সময় এখানে জমিদারি প্রথার সূচনা ঘটে, যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়। ১৭৬৭ সালে আবু তোরাবের নেতৃত্বে সন্দীপে বাংলার প্রথম কৃষক-বিদ্রোহ এবং ১৯৩০ সালে কংগ্রেস সভাপতি কালী কেশব ঘোষের নেতৃত্বে আইন অমান্য-আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সন্দ্বীপ থানা নোয়াখালী জিলার অধীনে ছিল। ১৯৫৪ সালে সন্দ্বীপ চট্টগ্রাম জেলার অমত্মর্ভুক্ত হয়।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখান থেকে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন।হাজার বছরের সভ্যতার লীলাভূমি সন্দ্বীপে বহু ক্ষণজন্মা মানুষ জন্মগ্রহন করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টির জনক কমরেড মুজফফর আহমদের মতো রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক রাজকুমার চক্রবর্তীর মতো দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান ও মাওলানা অজিউল্লাহর মতো মেধাবী আলেম, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামী আবু তোরাব চৌধুরীর মতো বীরযোদ্ধা, চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের সাহসী সৈনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের কৃতি ছাত্র বিপ্লবী লালমোহন সেন, আলীয়া নেছাবের মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা খানবাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক, মৌলভী বসির উদ্দীন এর মতো গর্বিত সন্তান সন্দীপের।

এ ছাড়া বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ রচয়িতাদের মাঝে স্থান করে নিয়েছিলো আমাদের একজন মীননাথ, কবি আবদুল হাকিম, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ফ্রন্ট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ, বেতারের প্রথম কণ্ঠস্বর আবুল কাশেম সন্দ্বীপসহ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ১১ জনের মধ্যে ৩ জনই সন্দ্বীপের গর্বিত সন্তান। দেশবরেণ্য শিশুসাহিত্যিক আফলাতুন এবং বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় এ সন্দ্বীপের অহংকার।

এ ছাড়া বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যেও রয়েছে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক যোগ্যতাসম্পন্ন, মেধাবী ও দায়িত্বশীল সন্দ্বীপ- সন্তান। চট্রগ্রাম কলেজে আমার অনেক বন্ধু ছিল সন্দীপের যারা প্রতিষ্ঠিত।সন্দ্বীপের রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন এখানে।

১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপে আসেন। ১৫৬৫ সালে ডেনিশ পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক সন্দ্বীপে আসেন এবং এর বহু প্রাচীন নিদর্শনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারি কাজী নজরুল ইসলাম রাজনীতিবিদ মোজাফ্‌ফর আহমেদের সাথে সন্দ্বীপে আসেন।

আসলে সন্দ্বীপের রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন এখানে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বন্ধু রনির সাথে আজ আমিও ফের সেই দলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.