৩৩ হাজার থেকে কমে ৩৫১
শরিফুল হাসান
বাংলাদেশ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৩৩ হাজার ৭৩ জন কর্মী সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) গিয়েছিলেন। জুলাই পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বরে গেছেন দুই হাজার ৩৩৭ জন। অক্টোবরে দাঁড়ায় ৩৫১ জনে এবং নভেম্বরে গেছেন ৩৫৫ জন।বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার ইউএইতে হঠাৎ জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হওয়াকে রপ্তানিকারকেরা দেখছেন ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে। ২০০৮ সালে কুয়েত এবং ২০০৯ সালে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর তাঁদের মূল ভরসা ছিল ইউএই। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ যৌথ কমিটি করে ইউএইকে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু শিগগির এই সংকট কাটবে এমন আশা দিতে পারছে না প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় কিংবা ইউএইতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস।বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলেনি ইউএই। তবে সেখানে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি, বাংলাদেশ দূতাবাস এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশটিতে সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশিরা যেমন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, তেমনি বাংলাদেশি শ্রমিকদের অপরাধপ্রবণতাও বেড়েছে। অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের সংখ্যাও অনেক। এসব কারণেই লোক নেওয়া বন্ধ রেখেছে দেশটি।জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার (অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরব, কুয়েত ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ। লিবিয়ার বাজারেও নানা সমস্যা। এই সংকটময় মুহূর্তে জনশক্তি রপ্তানি খাত টিকে ছিল আরব আমিরাতের বাজারের ওপর। কিন্তু দেশটি হঠাৎ করে বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা আগস্ট থেকেই সরকারকে বারবার এই সংকটের কথা বলেছি। কিন্তু সরকার সেভাবে সাড়া দেয়নি। বাজারটি পুরো বন্ধ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চরম হতাশ।’সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক বেগম শামসুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে আমরা আরব আমিরাতকে যৌথ কমিটি করে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছি। এখন তারা যেখানে বৈঠক করতে চায়, সেখানেই আলোচনায় বসা হবে। এটি ঢাকায় হতে পারে, তাদের ওখানেও হতে পারে।’বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে মোট ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ২০৩ জন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩৩ জনই গেছেন আরব আমিরাতে। গত কয়েক বছর গড়ে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার কর্মী দেশটিতে গেছেন। কিন্তু গত আগস্টের শেষে বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয় দেশটি।অপরাধ-প্রবণতা বেড়েছে: ইউএইর বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, জাল পাসপোর্ট, পাসপোর্টের ছবি ও তথ্য পরিবর্তন করে ইউএইতে এসে সম্প্রতি অনেক বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেককে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে বিভিন্ন হত্যা মামলায় অর্ধশত, অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগে ১৫ জন এবং মাদক কেনাবেচা ও সেবনে জড়িত অভিযোগে অন্তত ২৫ জন বাংলাদেশির বিচার চলছে। ভিসা ব্যবসা, চুরি, নারী পাচারসহ নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে কিছু বাংলাদেশির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশিদের অপরাধ-প্রবণতা বৃদ্ধিতে দেশটিতে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে।প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আমিরাতে গত দুই বছরে অনুমতি না পেয়ে কিংবা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এঁদেরও নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখছে ইউএই।জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক বলেন, আমিরাতে কিছু বাংলাদেশির অপরাধ-প্রবণতা বেড়েছে। তাঁদের কারণে সমস্যায় পড়ছেন অন্যরা।অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, কিছু বাংলাদেশির কারণে পুরো দেশের যেন ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আরব আমিরাতের বাজার বন্ধ থাকলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বিপর্যয় কাটবে না। কাজেই সরকারের উচিত সবাইকে নিয়ে দ্রুত কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা।