শুক্রবারের বিশেষ

Spread the love

ঈদের ছুটিতে বেড়ানোর ধুম

শরিফুল হাসান

.
.

ঈদের লম্বা ছুটিতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে যাচ্ছেন চারুশিল্পী আরাফাত রুবেল। আর বন্ধুদের নিয়ে সিলেটে বেড়াতে যাচ্ছেন ইউসুফ আহমেদ।
একটা সময় অবকাশ পেলেই পৈতৃক নিবাসে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ছুটতেন লোকজন। এখন অনেকে ছুটি পেলেই পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে ছুটছেন বিভিন্ন অবকাশযাপন কেন্দ্রে। দুই ঈদে সেটা পরিণত হয় জনস্রোতে।

পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার ঈদের লম্বা ছুটিতে অন্তত ১০ লাখ মানুষ দেশের ভেতরের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে যাবেন।

আর এক থেকে দেড় লাখ মানুষ পাড়ি জমাচ্ছেন দেশের বাইরের বিভিন্ন অবকাশকেন্দ্রে। বেশির ভাগের গন্তব্য ভারত ও নেপাল। তবে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীনসহ নানা দেশে যাচ্ছেন অনেকে।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং ট্যুর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মুহূর্তে দেশের সব হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট মিলিয়ে দিনে সর্বোচ্চ দেড় লাখ মানুষের থাকার সুযোগ রয়েছে। এর অর্ধেকই কক্সবাজারে। এ ছাড়া কুয়াকাটায় ১০ হাজার এবং সিলেট ও মৌলভীবাজারে ১৫ হাজার লোকের থাকার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার চারপাশে গড়ে উঠছে শতাধিক রিসোর্ট। সেগুলোয় হাজার সাতেক লোকের থাকার ব্যবস্থা আছে। ঈদের ছুটি সামনে রেখে এগুলোর ৭০ ভাগই বুকিং হয়ে গেছে।

বাঙালির ভ্রমণের বাতিক খুব সাম্প্রতিক ঘটনা বলে উল্লেখ করে টোয়াবের পরিচালক ও জার্নি প্লাসের প্রধান তৌফিক রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভ্রমণপিয়াসী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। দুই ঈদে সেটা সবচেয়ে বেশি হয়। সামর্থ্যবানেরা ছুটিতে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। অনেকেই দেশের ভেতরে বেড়াবেন। এগুলো পর্যটনের জন্য ভালো লক্ষণ।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ভ্রমণবিষয়ক সবচেয়ে বড় গ্রুপের নাম ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশ। সেখানে ঈদ সামনে রেখে মানুষ কক্সবাজার, বান্দরবান, সাজেক, সিলেট, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর কথা বলছেন। আর তরুণেরা মিরসরাইয়ের খইয়াছড়া, বান্দরবানের নাফাকুম, আমিয়াকুম, সিলেটের বিছনাকান্দি কিংবা রাতারগুলের মতো জায়গাগুলোতে বেড়াতে যাচ্ছেন।

>১০ লাখ পর্যটক দেশের ভেতর ঘুরতে বের হবেন
দেড় লাখ লোক ঘুরতে যাবেন দেশের বাইরে
আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতে পারে পর্যটন খাতে

বিদেশে পাড়ি

পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঈদে ৫০-৬০ হাজার মানুষ ভারতে বেড়াতে যান। গত রোজার ঈদে পর্যটকদের ভিসা দিতে ঢাকায় আলাদা ভিসা ক্যাম্প চালু করেছিল ভারতীয় দূতাবাস। সেখানে দুই সপ্তাহের ক্যাম্পে ৫৬ হাজার ৩১৮ জনকে ভ্রমণ ভিসা দেওয়া হয়। তাঁদের অনেকে এবারের কোরবানির ঈদেও ঘুরতে যাচ্ছেন। আবার অনেকে নতুন করে ভিসা নিয়েছেন।

বাংলালায়নের সহকারী ব্যবস্থাপক হাসানুর রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের লম্বা ছুটিতে তিনি ১০ বন্ধু মিলে ভারতের দিল্লি, আগ্রা ও জয়পুর যাচ্ছেন। এর আগে রোজার ঈদে দেশের ভেতরে বেড়িয়েছেন।

বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিলশাদ হোসাইন পরিবারের সঙ্গে যাচ্ছেন মালদ্বীপে। তিনি জানান, বহুদিন ধরে তাঁর এই দেশটি ঘোরার ইচ্ছা ছিল। এবারের লম্বা ছুটিতে সেটি পূরণ হচ্ছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি মনজুর মোরশেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের ছুটিতে এবার এক লাখের মতো লোক দেশের বাইরে বিভিন্ন অবকাশকেন্দ্রে যাচ্ছেন। ৭ সেপ্টেম্বর থেকেই এয়ারলাইনসগুলোতে প্রচণ্ড ভিড়। প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় ভারতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বেড়াতে যাচ্ছেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপেও যাচ্ছেন বিপুলসংখ্যক পর্যটক। আবার অভ্যন্তরীণ রুটেও প্রায় ২০ হাজার লোক দেশের ভেতরের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাবেন।

টোয়াবের তথ্য অনুযায়ী, সারা বছরই পর্যটকেরা ছুটছেন দেশ থেকে দেশে। ভারতে প্রতিবছর বেড়াতে যান পাঁচ থেকে ছয় লাখ পর্যটক। এর পরের সবচেয়ে বড় গন্তব্য মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। প্রতিবছর দেড় লাখ মানুষ মালয়েশিয়ায় আর এক লাখ মানুষ থাইল্যান্ডে যান বেড়াতে। ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যটক যান সিঙ্গাপুরে। এ ছাড়া নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় ভিসা লাগে না বলে সেখানেও যাচ্ছেন বিপুলসংখ্যক পর্যটক।

দেশের ভেতরে পর্যটক বাড়ছে, বাড়ছে অবকাঠামো

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হিসাব বলছে, দেশের ভেতরে এখন বছরে ৮০ লাখ লোক ভ্রমণে বের হচ্ছেন। গত চার-পাঁচ বছরে এই সংখ্যা বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ হারে বেড়েছে।

পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক পরিবার এখন সঞ্চয়ের একটা অংশ আলাদা করে রাখে ভ্রমণের পেছনে। দ্রুত বাড়তে থাকা এই ভ্রমণ বাতিকের কল্যাণে দেশে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন অবকাঠামো। হোটেল-মোটেল ও রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি পর্যটন ব্যবস্থাপনার জন্য গড়ে উঠছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর পেছনে এখন এক বিরাট অর্থনীতি।

টোয়াবের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি এবং বেঙ্গল ট্যুরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন বলেন, ‘পর্যটকদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। আমাদের ধারণা বছরে প্রায় দুই লাখ উচ্চবিত্ত পর্যটক দেশের বাইরে অবকাশ কেন্দ্রে বেড়াতে যান। দেশের ভেতর উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যটক লাখ খানেক। বাকিরা মধ্যবিত্ত ও নিম্মমধ্যবিত্ত। তিনি বলেন, একজন উচ্চ মধ্যবিত্ত পর্যটক প্রতিদিন ভ্রমণে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করেন। একজন মধ্যবিত্তের সেই বাজেটর পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা। আর নিম্ম মধ্যবিত্ত পর্যটক দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে খরচ সীমিত রাখেন।

বাংলাদেশের অন্যতম বড় ট্যুর অপারেটর গ্রিন হলিডেজ ট্যুরের প্রধান নির্বাহী বোরহানউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ভেতরের সবচেয়ে বড় পর্যটনের স্থান কক্সবাজার। সেখানে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার লোকের এক দিন থাকার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া রাঙামাটি ও বান্দরবানেও অনেকে বেড়াতে যান। সিলেট ও মৌলভীবাজারের নতুন রিসোর্টগুলোতেও যাচ্ছেন একটু সামর্থ্যবানেরা।

পর্যটনের অর্থনীতি

সরকারি ও বেসরকারি তথ্য বলছে, পর্যটন খাতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আট বিলিয়ন ডলার বা ৬২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা আয় হয়েছে। এর একটি বড় অংশই আয় হয়েছে ঈদে। ২০১৫ সালে শুধু দুর্গাপূজার ছুটিতে ভ্রমণে এক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (বিপণন) পারভেজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, মানুষের এখন সামর্থ্য বেড়েছে বলে ভ্রমণের ইচ্ছা বেড়েছে। ফলে এই খাতের অর্থনীতিও চাঙা। পারভেজ আহমেদ বলেন, ‘আমরা হিসাব কষে দেখেছি, একেকটা ঈদের ছুটিতে পর্যটন খাতে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। পরিবহন, আবাসন, খাবার ও বিনোদন—এই চারটি খাত ধরলে এবারের ঈদে আড়াই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতে পারে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান সাকের আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে ভ্রমণের অভ্যাস ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় অবকাঠামো বাড়ছে না। দেশে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। যাঁদের সামর্থ্য বেশি, তাঁরা বিদেশে বেড়াতে যান। বাকিরা দেশের ভেতরে স্বস্তিতে ঘুরবেন, তেমন অবকাঠামো খুব বেশি নেই। কক্সবাজারে তা-ও অপরিকল্পিতভাবে কিছুটা গড়ে উঠেছে। কিন্তু অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রে তা-ও নেই। তবে দেশের ভেতরে মানুষ যত বেশি বেড়াতে যাবেন, ততই অবস্থার উন্নতি হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published.