লাইবেরিয়ার মাথাপিছু আয় ১৭০ ডলার, যা বাংলাদেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ

Spread the love

নতুন শ্রমবাজার, প্রতারণা পুরোনো

শরিফুল হাসান

নিউজিল্যান্ডে ভালো বেতনে কৃষিকাজ করতে হবে, এ কথা বলে আট যুবককে নেওয়া হয়েছিল মালয়েশিয়ায়। বলা হয়, মালয়েশিয়া থেকে ভিসা করে তাঁদের নিউজিল্যান্ডে পাঠানো হবে। কিন্তু তাঁদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে নিউজিল্যান্ডের যে ভিসা দেওয়া হয়, তা ছিল জাল। পরিণতিতে ওই আট যুবক সব হারিয়ে দেশে ফিরেছেন।প্রায় একই রকম প্রতারণার শিকার হয়ে সম্প্রতি স্পেনে ৪৮ জন, আফ্রিকার লাইবেরিয়ায় ৩৯ জন ও বুরুন্ডিতে ২৩ জন বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। জেল খেটে বা হয়রানি-নির্যাতন ভোগ করে তাঁরা দেশে ফিরেছেন। প্রতারিত হয়ে এ মুহূর্তে সুইডেনে আছেন ৩০০ বাংলাদেশি।সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং জনশক্তি নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে লোক পাঠানোর নামে প্রতারণা চলছে।ভাগ্য বদলাতে বিদেশে গিয়ে উল্লিখিত মানুষগুলো এখন নিঃস্ব। তাঁরা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ইতালি, পোল্যান্ড, বারমুডা, ফিজি, নিউগিনি, কঙ্গো, বতসোয়ানাসহ ইউরোপ ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ভালো বেতনে চাকরির কথা বলে ইদানীং প্রতারণা চলছে। এক শ্রেণীর অবৈধ জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও কিছু ট্রাভেল এজেন্সি এর সঙ্গে জড়িত। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বলে জানতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বিদেশগামী কর্মীদেরও সচেতন থাকতে হবে।’প্রতারণা বন্ধে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি গঠিত টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর আগে অবশ্যই একটি পন্থা বের করতে হবে, যাতে এ ধরনের সমস্যা না হয়। তিনি আরও বলেন, কারও খামখেয়ালির জন্য যাতে কোনো বাজার নষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।প্রতারণার ঘটনাগুলো: নিউজিল্যান্ডে পাঠানোর নামে প্রতারণার শিকার হয়েছেন আট যুবক। তাঁরা হলেন আবু আল রাজিন, রুহুল আমিন, শান্ত ঘোষ, নেসার উদ্দিন, আবুল কাশেম, রাশেদ হোসাইন, মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম ও আবদুর রহিম।তাঁদের একজন কেরানীগঞ্জের শান্ত ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামের এক দালাল আমার কাছ থেকে প্রথমে চার লাখ টাকা নেয় ইতালি পাঠানোর কথা বলে, কিন্তু ইতালি পাঠায়নি। সম্প্রতি সে আমাকে বলে, নিউজিল্যান্ডে ভালো কাজ আছে। মাসে লাখ টাকা বেতন। এরপর রুহিতপুর রাইস এজেন্সি নামের একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক হাজী মোয়াজ্জেম আমাদের আটজনকে ট্যুরিস্ট (পর্যটক) ভিসায় মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে নিউজিল্যান্ডের ভিসার জন্য আমার কাছ থেকে আরও তিন লাখ টাকা নেওয়া হয়।’শান্ত ঘোষ জানান, নিউজিল্যান্ডের কথিত ভিসা হলেও বারবার তাঁদের ফ্লাইট পেছানো হয়। এরই মধ্যে মালয়েশিয়ার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। তখন স্থানীয় এক বাঙালির সহায়তায় তাঁরা মালয়েশিয়ার অভিবাসনবিষয়ক একটি বেসরকারি সংস্থা তানাগানিতায় যান। তারা খোঁজ নিয়ে জানায়, নিউজিল্যান্ডের ওই ভিসা আসলে জাল। পরে তানাগানিতার সহায়তায় দেশে ফেরেন শান্ত ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীরা।অভিবাসনবিষয়ক স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা আইএমএ ফাউন্ডেশনের জাতীয় সমন্বয়ক আনিসুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, নিউজিল্যান্ডের মতো বিভিন্ন নতুন গন্তব্যে পাঠানোর কথা বলে প্রতারণা ক্রমেই বাড়ছে।পশ্চিম আফ্রিকার গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লাইবেরিয়াতেও মানুষ পাঠাচ্ছে বিবেকহীন মানব পাচারকারীরা। সেখানে তিন মাস আটক থেকে সম্প্রতি ফিরেছেন ৩৯ বাংলাদেশি। জাতিসংঘের লাইবেরিয়া শান্তি মিশনের বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় সম্প্রতি তাঁরা দেশে ফেরেন।লাইবেরিয়া-ফেরত কয়েকজন শ্রমিক জানান, তাঁদের কাছ থেকে জনপ্রতি তিন থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের কাতার, নাইজেরিয়া ও ঘানা হয়ে লাইবেরিয়ায় নেওয়া হয়। দালালরা কাজ না দিয়ে তাঁদের বিভিন্ন জায়গায় আটকে রাখে।প্রতারিত ওই বাংলাদেশিদের একজন ঈশ্বরদীর শিমুল খন্দকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি পেশায় ট্রাকচালক। একদিন বিদেশে লোক পাঠানোর দালাল গ্রামের শওকত তাঁকে ডেকে বলেন, ‘দেশে ড্রাইভারি করে কী হবে, ভালো ভিসা আছে, তুই বিদেশে গেলে মাসে ৫০ হাজার টাকা পাবি।’শিমুল জানান, তাঁর কাছ থেকে দালাল শওকত মোট সাড়ে চার লাখ টাকা নেয়। লাইবেরিয়া পৌঁছলে অমিত দাস নামের এক বাংলাদেশি তাঁদের একটি বাড়িতে নিয়ে সব টাকা-পয়সা কেড়ে নেয় এবং জঙ্গলের ভেতর আট দিন আটকে রাখে।শিমুল খন্দকার বলেন, ‘খাবার না পেয়ে আমরা এক পর্যায়ে আধমরা অবস্থায় রাস্তায় নেমে আসি। আমাদের অবস্থা দেখে সাধারণ মানুষ পুলিশকে খবর দেয়। পরে বাংলাদেশি শান্তি মিশনের সদস্যরা এসে ঘটনা শুনে আমাদের একটি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেন। লাইবেরিয়ান পুলিশ আমাদের থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং পাঁচ পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তিন দালাল পালিয়ে যায়।’উল্লেখ্য, বিপর্যস্ত অর্থনীতির লাইবেরিয়ায় শ্রমিক রপ্তানির নির্ভরযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। জাতিসংঘের ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, সে দেশের মাথাপিছু আয় মাত্র ১৭০ ডলার, যা বাংলাদেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ।এদিকে জঙ্গলের বেরি ফল তোলার কথা বলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সুইডেনে নেওয়া হয় ৩০০ বাংলাদেশিকে। কিন্তু কাজ না পেয়ে এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকে অবৈধভাবে পালিয়ে গেছেন ইউরোপের অন্য দেশে।সুইডেনে প্রতারিত আলমগীর আলী, আবদুল আলিম ও হাসান আলী প্রথম আলোকে জানান, সুইডেনপ্রবাসী বাংলাদেশি আবু বকর সিদ্দিক বেরি ফল তোলার কথা বলে তাঁদের নিয়ে যান। প্রতি মাসে সাড়ে ১৭ হাজার ক্রোনার করে তিন মাসে ৫০ হাজার ক্রোনার বা দেড় লাখ টাকা বেতনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু সুইডেনে গিয়ে তাঁরা কোনো কাজই পাননি।স্পেন ও বুরুন্ডি: পূর্ব আফ্রিকার দেশ বুরুন্ডিতে জাল কাগজের কারণে জুন মাসে ২৩ জন বাংলাদেশিকে আটক করে পুলিশ। বুরুন্ডির পুলিশ বলেছে, ওই বাংলাদেশিরা কাজের কথা বলে দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁদের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের কোনো কাগজপত্র ছিল না। একইভাবে স্পেনের পুলিশ কাগজপত্রহীন ৪৮ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় তাঁরা দেশে ফিরে আসেন।জড়িত অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি: স্থানীয় কিছু অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, ট্রাভেল এজেন্সি ও দালাল এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে অভিবাসন পুলিশ। সুইডেনে ৩০০ লোক পাঠানোর সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ওয়ার্কফোর্স (আরএল-১০৯৫)। লাইবেরিয়ায় লোক পাঠানোর সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ এক্সপোর্ট করপোরেশন (আরএল-৮০৩), তাসলিম এয়ার ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৮৮৯), ইস্ট ওয়েস্ট ট্রেড লিঙ্কার্স (আরএল-৮৮৯), দ্য রিচ ইস্টার্ন (আরএল-৫২৭), সি সেল বাংলাদেশ লিমিটেড (আরএল ৬৯৮), আফিয়া ওভারসিজ (আরএল-১০১০), শাম্স কোম্পানি (আরএল-৬৯৬), এইচএ ইন্টারন্যাশনাল (আরএল-৪৬৯) ও এ আর ট্রেড লিমিটেড (আরএল-৭৭৪)। এই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নিয়ে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠিয়েছিল।রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর প্রতারণার ব্যাপারে জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী এর দায় নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতারণার সঙ্গে জড়িত কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির দায় বায়রা নেবে না।’প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কেফায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন কোনো বাজারের সার্বিক অবস্থা না জেনে সেখানে লোক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। নতুন কোনো বাজারে লোক পাঠাতে হলে একজন সরকারি প্রতিনিধি পাঠানো উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published.