মালয়েশিয়ার জেল ও শিবিরে বন্দী দেড় হাজার বাংলাদেশি

Spread the love

শরিফুল হাসান

জুয়েল রানার বাড়ি মেহেরপুর সদরের রাইপুর এলাকায়। দুই লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে গত বছর এমাছেক প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি মালয়েশিয়া যান। কথা ছিল ভালো বেতনের চাকরি পাবেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার মাসখানেক পরেই পুলিশ তাঁকে আটক করে। কিছুদিন জেল খেটে শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে চলে আসতে বাধ্য হন। জুয়েল রানা দেশে ফিরে আসতে পারলেও ভাগ্য সহায় হয়নি অনেকের। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শিবিরে ও জেলে দিন কাটাচ্ছেন এক হাজার ৪৫৭ জন বাংলাদেশি। তাঁদের বেশির ভাগকেই আটক করা হয়েছে অভিবাসন আইন ভাঙার জন্য। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কেফায়েত উল্লাহ বলেন, বিদেশে কোনো শ্রমিক গ্রেপ্তারের খবর পেলেই দূতাবাসের মাধ্যমে তাঁরা খোঁজখবর নেন এবং মুক্ত করার চেষ্টা করেন। মালয়েশিয়ার এই শ্রমিকদের বিষয়টি হাইকমিশন এবং মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তাঁদের কীভাবে দেশে ফেরত আনা যায়, সে ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট আছে। তবে অবৈধভাবে যেন কেউ মালয়েশিয়ায় না যান, সে ব্যাপারে তিনি সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। কেফায়েত উল্লাহ জানান, আটক শ্রমিকদের মুক্তিসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী এ মাসেই মালয়েশিয়া যাবেন। আশা করা যায়, এরপর ইতিবাচক কিছু হবে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব ও শ্রম কাউন্সেলর মাসুদুল হাসান বলেছেন, কোনো শ্রমিকের গ্রেপ্তারের সংবাদ জানতে পারলেই হাইকমিশন তাঁর ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়। এরপর তাঁরা যে কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে সরাসরি অভিবাসন কর্তৃপক্ষকেও চিঠি দিয়ে শ্রমিকদের মুক্তির অনুরোধ জানানো হয়। যেসব কারণে গ্রেপ্তার: মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের কারণে অথবা মালয়েশিয়ায় থাকার বৈধ কাগজপত্র না থাকার কারণে এসব বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও পালিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন। ফলে তাঁরা গ্রেপ্তার হন। মাসুদুল হাসান জানান, মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন-১৯৫৯-এর ধারা ৬(১) সি/১৫ (১) সি এবং পাসপোর্ট আইন ১৯৬৬-এর ১২ (১) ধারা অনুযায়ী এসব বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন-১৯৫৯-এর ৬(১) সি ধারায় বলা হয়েছে, বৈধ অনুমতি ছাড়া কেউ মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারবে না। আর ১৫ (১) সি-তে বলা হয়েছে, কেউ যিনি দিনের ভিসা বা অনুমতি নিয়ে মালয়েশিয়া আসবেন, সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর থাকতে পারবেন না। পাসপোর্ট আইন ১৯৬৬-এর ১২ (১) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি পাসপোর্ট বা ভিসা জালিয়াতি করেন বা কোনো মিথ্যা তথ্য দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। হাইকমিশন ও মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা অনেকেই জানিয়েছেন, অনেকেই সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া আসেন এবং তাঁদের এই ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া অনেকেই নির্ধারিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মালয়েশিয়া থাকেন। ফলে পুলিশ তাঁদের আটক করে। বিভিন্ন শিবিরে বন্দী ৯২৯ জন: মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শিবিরে মোট ৯২৯ জন আটক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে লেংগিং শিবিরে এক নারীসহ মোট ২৯১ জন বন্দী আছেন। মাসুদুল হাসান জানান, কাউকে গ্রেপ্তারের পরপরই শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারের রায় হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে শিবিরে থাকতে হয়। রায় হওয়ার পর তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। আবার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দেশে ফেরত আসার আগেও তাঁকে কয়েক দিন শিবিরে থাকতে হতে পারে।মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসা ফেরদৌস ও জুয়েল নামের দুই শ্রমিক জানান, শিবিরগুলোতে প্রায়ই বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতন করা হয়। অনেক সময় ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না। বিভিন্ন সময়ে ফেরত আসা আরও অনেক শ্রমিক একই অভিযোগ করেছেন। জেল খাটছেন ৫২৮ জন: মালয়েশিয়ার জেলে সাজা খাটছেন এক নারীসহ ৫২৮ জন। অভিবাসন আইন ভাঙায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জেলিবু জেলে ৩২ জন সাজা খাটছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা আইন ১৯৯০-এর অধীনে শাদুল ইসলাম নামের একজন সাজা খাটছেন টেমপাট তাহানান পারলিনডুংগান জেলে। অসাধু আদম ব্যবসায়ীরা দায়ী: মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা একাধিক শ্রমিক এবং জনশক্তি রপ্তানিকারক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অসাধু কিছু প্রতিষ্ঠান দেড় থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে শ্রমিকদের টুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছে। কিন্তু মাসখানেক পর এই টুরিস্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে এই শ্রমিকেরা অবৈধ হয়ে পড়েন এবং পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা শ্রমিক মেহেরপুরের ফেরদৌস জানান, এক লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁকে ভ্রমণ ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। গোপনে কাজ করার প্রায় দুই মাস পর পুলিশ তাঁকে আটক করে। এরপর তাঁকে জেলে থাকতে হয় অনেক দিন। শেষমেশ তাঁকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফেরদৌস জানান, এভাবে অনেক শ্রমিককে ভ্রমণ ভিসায় মালয়েশিয়া পাঠিয়ে বিপদে ফেলা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তা মাসুদুল হাসান সম্প্রতি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে জানান, জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হান্নান ব্রাদার্স (আরএল নম্বর ৫৫২), এমাছেক প্রাইভেট লিমিটেড (আরএল নম্বর ৮৭৪) ও জামান ভাই (আরএল নম্বর ১৫৩)-এর মাধ্যমে পাঠানো শ্রমিকদের কাজের অনুমতিপত্র নেই। ফলে তাঁরা কাজ করতে পারছেন না। এ রকম ৪৫ কর্মী জুহুরবারু জেলে আছেন। কোম্পানি ও স্থানীয় এজেন্টদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেয়নি। হান্নান ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. নুরুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, মালয়েশিয়ায় তাঁদের যে প্রতিনিধি আছেন, তাঁরা তাঁর মাধ্যমে পাঠানো শ্রমিকদের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন। একই কথা বলেছেন জামান ভাইয়ের স্বত্বাধিকারী এ বি এম আমানুজ্জামান। এমাছেক প্রাইভেট লিমিটেডের স্বত্ব্বাধিকারী মনির হোসেনও বলেছেন, তাঁরা তাঁদের শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান করেছেন। তবে এমাছেক কেম্পানির মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে ফিরে আসা একাধিক শ্রমিক প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেছেন, তাঁরা দেশে ফিরে এসে যোগাযোগ করলে কোম্পানির মালিক তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ফলে ক্ষতিপূরণের জন্য তাঁরা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক বরাবর দরখাস্ত দিয়েছেন। এই তিনটি ছাড়াও আরও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, কিছু দালাল চক্র এভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূল থেকে টাকা নিয়ে মালয়েশিয়া লোক পাঠায় একশ্রেণীর দালাল। প্রায়ই সাগরে তাঁদের বিপদে পড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত যাঁরা মালয়েশিয়া পৌঁছান, তাঁরাও আবার গ্রেপ্তার হন অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে। সম্প্রতি এভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় পথে বিপদে পড়ে প্রায় দুই শ শ্রমিক ভারতের আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে আশ্রয় নেন। পরে ভারত সরকারের সহায়তায় তাঁদের দেশে ফেরত আনা হয়। মুক্তির জন্য যা করা হচ্ছে: মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বন্দী বাংলাদেশিদের মুক্তির জন্য তাঁরা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাসুদুল হাসান জানান, হাইকমিশনের কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে শিবিরগুলো সফর করছেন এবং বন্দী নাগরিকদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে রাখছেন। একই সঙ্গে তাঁদের মুক্তির জন্য যে কোম্পানিতে তাঁরা চাকরি করতে এসেছিলেন, সেসব নিয়োগকর্তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।মাসুদুল হাসান জানান, গ্রেপ্তার বাংলাদেশিদের বিচারপর্বে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য হাইকমিশন থেকে দোভাষী পাঠানো হয়। বরাদ্দ বাজেটের মধ্যে যত দূর সম্ভব আইনি সহায়তার জন্য আইনজীবীও নিয়োগ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.