বিস্ময় বাংলাদেশ!

Spread the love

শরিফুল হাসান

আমার কাছে এক বিস্ময় ও আশাবাদের নাম বাংলাদেশ!বলতে দ্বিধা নেই, রাজনীতি, রাষ্ট্র, সরকার, বেসরকারি খাতসড় এই দেশের সব খাতেই কম বেশি সংকট আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন, নাগরিক সেবা, বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে এমন কোন খাত নেই যেখানে সংকট নেই। বরং আছে সুশাসনের বেশ ঘাটতি। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, দুর্ণীতি, টাকা পাচার, যানজটসড় কতো কতো যে সমস্যা আছে।

কিন্তু এতো কিছুর পরেও বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর। আর সে কারণেই আমার এক আশাবাদের নাম কাছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই অগ্রগতির পেছনে সরকারের কম-বেশি ভূমিকা নেই তা নয় অবশ্যই আছে। কিন্তু তারচয়ে এই দেশে তরুণ সমাজ, এই দেশের কৃষক, প্রবাসী, গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ভূমিকা বোধহয় বেশি। এই যে এতো এতো সংকটেরও পরেও মানুষ এখানে আশা হারায় না, বারবার ঘুরে দাঁড়ায় এটাই তো শক্তি।

হ্যা এই দেশ নিয়ে অনেক হতাশা আমার আছে, সুশাসন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, আছে অনেক সমালোচনা যেগুলো আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বলতে পারবো। কিন্তু এরপরেও গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের কিছু অর্জনকে আমার বিস্ময়কর অর্জন মনে হয়। এরমধ্যে সবার আগে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু আমার কাছে একটা বিস্ময়ের নাম। লেখাপড়া ও গবেষণায় নানা সমস্যা থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাঠে একটা বিস্ময়ের নাম।

এই দেশের প্রবাসী শ্রমিক, এই দেশের কৃষি, পোশাক শ্রমিকরা আমার কাছে বিস্ময়। আশির দশকে এই দেশের গ্রামেগঞ্জে পোলটি ও মৎস্য সম্পদ এবং পরে প্রাণীসম্পদকে কেন্দ্র করে নানা উদ্যোগ আমার কাছে একটা বিস্ময়। গ্রামে গ্রামে যুবক-তরুণরা যে ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করলো সেই এসএমইখাতের অর্জন আমার কাছে এক বিস্ময়। এই দেশের নারীর জেগে ওঠা আমার কাছে এক বিস্ময়। বিপুল সংখ্যক মেয়েদের স্কুলে যাওয়া আমার কাছে এক বিস্ময়।

সবার হাতে হাতে মোবাইল একটা বিস্ময়। বিকাশ না নগদের মতো প্রযুক্তি আমার কাছে বিস্ময়। লাখ লাখ তারুণ্যের ফ্রিল্যান্সিং আমার কাছে একটা বিস্ময়। এতো সংকটেরও পরেও এই দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্যোক্তা হচ্ছেন সেটা আমার কাছে একটা বিস্ময়। বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অর্জন আমার কাঠে একটা বিস্ময়। মেট্টোরেল না হলেও বিশাল পদ্মা নদীতে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু আমার কাছে একটা বিস্ময়। লিখতে গেলে তালিকা আরো লম্বা হবে।

নানা বিস্ময়ের অর্জনে আমার যেমন বিস্ময় আছে তেমনি যদি কেউ হতাশার কথা জানতে চান আমি বলবো সুশাসনের অভাব আমার কাছে একটা হতাশার নাম। এই দেশে সেই অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক সবকছিুর কারণে প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠাটা আমার কাছে ভীষণ হতাশার। আমার বারবার মনে হয় এই দেশের তরুণরা যদি ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে যুক্ত না হয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না গড়ে তাহলে শত উন্নয়ন অর্জনের পরেও আমরা যে কোন সময়ে সংকটে পড়তে পারি।

দীর্ঘ দুই দশক সাংবাদিকতার কারণে আমি এই দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছি এবং সরকারি বেসরকারি প্রায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানি। আমার সবসময় মনে হয়, এই দেশে যদি বিশ্বমানের কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতো যদি আমাদের প্রাতষ্ঠিানিক কাঠামো গড়ে উঠতো! ব্যক্তি চর্চার বদেলে যদি প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠতো। এই আলাপ এলেই আমার হতাশ লাগে এবং সেই হতাশার মধ্যে আমার কাছে এক বিস্ময়ের নাম ব্র্যাক। সত্যি বলছি, প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমার কাছে এক বিস্ময়ের নাম ব্র্যাক যেটি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা।

শুধু আমার কাছে নয় গোটা পৃথিবীতেও ব্র্যাক এখন একটা বিস্ময়! মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ব্র্যাকের জন্ম, বাংলাদেশের সঙ্গে ব্র্যাক সমান্তরালভাবে ব্র্যাকের বেড়ে ওঠা এবং এই দেশের প্রায় প্রতিটা সংকট বা সমস্যার সমাধানে ব্র্যাকের যুক্ততা আমার কাছে বিস্ময়কর। আমি যদি কখনো ব্র্যাকে নাও থাকি তাও এই গল্প বলে বাড়াবো। কারণ জাতিসংঘ, বা ইউরোপ বা আমেরিকায় গড়ে ওঠা কোন প্রতিষ্ঠান সাধারণত এশিয়া বা আফ্রিকার মতো কোন দেশে গিয়ে উন্নয়ন করছে গোটা পৃথিবী সেটা দেখতেই অভ্যস্ত।

সেই জায়গায় বাংলাদেশের একটা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক গত ৫১ বছর ধরে বাংলাদেশে দারুণভাবে সফলভাবে কাজ করে আফ্রিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল নামে কাজ করছে। আফ্রিকাসহ বহু দেশ চাইছে ব্র্যাক তাদের পাশে থাকুক যেভাবে ছিলো বাংলাদেশে। শুনে অবাক হবেন আফ্রিকার যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোন দেশে নেমে আপনি বাংলাদেশের পরিচয় দিলে ওরা জানতে চাইবে শান্তি মিশন নাকি ব্র্যাক? এই যে দেশে দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে সেও এক বিস্ময়। সত্যি বলছি গত ছয় বছর ব্র্যাক কাজ না করলে আমিও জানতাম না ব্র্যাক এতো বিস্তৃত!

একবার ভাবেন ৬৪ হাজার স্কুল ছিলো ব্র্যাকের। কোটি মানুষ শুধু লেখাপড়াই করেছে সেখানে। চিনি,গুড়ের ওরস্যালাইন বলেন, ভ্যাক্সিন বলেন, প্রায় অর্ধশত দেশে একেবারে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ব্র্যাকের আলট্রা পুওর গ্রাজুয়েশ কর্মসূচি, কিংবা গ্রামীণ মানুষকে অর্থনীতিতে যুক্ত করতে বিকাশ এর যে কোন একটাই গোটা পৃথিবীর উন্নয়ন পাঠ হতে পারে। এই তো কয়েকমাস আগে আমাদের লিডারশিপের একটা ট্রেনিংয়ে এক বিদেশি জিজ্ঞেস করছিলো, তোমার হাতে একটা ম্যাজিক থকলে এবং তুমি যা ইচ্ছে করতে চাইলে কী করতে?

উত্তরে আমি বলেছিলাম আমি পৃথিবীর সব মানুষকে বাংলাদেশ, ব্র্যাক এবং স্যার আবেদের কাজের কথা জানাতাম। কারণ ব্র্যাক এবং স্যার আবেদ শিখিয়েছেন মানুষের কাছেই সব সমস্যার সমাধান আছে। মানুষই সব শক্তির উৎস। আর মানুষের জন্য না বরং মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে হয়। আমার বিশ্বাস এই গল্প জানলে পৃথিবীর প্রতিটা দেশ তার সংকটের সমাধান নিজেই করে ফেলতে পারবে।

আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় যে যেই পেশায় থাকুক প্রতিটা মানুষকে যদি তিনমাস অন্তত ব্র্যাকে কাজ করতেন। নিশ্চয়ই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটা শিখে ফেলতেন। জানি না গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে কীভাবে এই বার্তাগুলো দেওয়া যায় কীভাবে ব্র্যাকের বিস্ময়ের কথা জানানো যায় কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ়তা, সাহস ও এগিয়ে যাওয়ার গল্প এই দেশের সবাইকে জানাতে ‘হোপ ফেস্টিভ্যাল’বা আশার উৎসবের আয়োজন করতে যাচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক।

২০২২ সালের ২১ মার্চ ব্র্যাক ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব হিসেবে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে আগামী ৯, ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি এই উৎসব হবে। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত উৎসব চলবে। ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’, ‘সম্ভাবনার শক্তি’ ও ‘যে পৃথিবী আমরা গড়তে চাই’—তিন দিনে তিনটি প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে উৎসব হবে। এটি সবার জন্য উম্মুক্ত। এতে যোগ দিতে কোন অর্থ খরচ করতে হবে না। ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধনের মাধ্যমে আগ্রহী ব্যক্তিরা কোনো প্রবেশমূল্য ছাড়াই উৎসবে অংশ নিতে পারবেন।শুধু অংশগ্রহণকারী হিসেবে নিবন্ধন নয় কেউ যদি মনে করেন এই দেশের সামাজিক কোন সমস্যা সমাধানে তিনি যুক্ত হতে চান তিনি নিজের উদ্ভাবনী ধারণা নিবন্ধন পোর্টালের মাধ্যমে জমা দিতে পারবেন।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ ভাই যেমনটা বলছিলেন, এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা আগামী দিনের পথচলায় ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে সবাইকে যুক্ত করতে চাই।’উৎসবে থাকবে আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির সম্মিলন, পুঁথিপাঠ, গল্পপাঠের আসর, বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, শিশুদের খেলার জগৎ ও দিনব্যাপী নানা প্রদর্শনী। দেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে প্রতিদিনই অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। থাকবে গয়না বানানো, কারিগর ও কার্টুনিস্টদের সঙ্গে আনন্দদায়ক কর্মশালায় যোগ দেওয়ার সুযোগ।

তিন দিনের অনুষ্ঠানমালার বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নেবেন অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু, রকসংগীত তারকা জেমস, সংগীতশিল্পী অর্ণব। ওয়ারফেজ, লালন, নেমেসিস, আর্টসেলের মতো ব্যান্ড দল আয়োজনে অংশ নেবে।আগেই বলেছি এটি সবার জন্য উম্মুক্ত। https://brachopefestival.net এই লিঙ্কে গিয়ে যে কেউ রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা কোনো প্রবেশমূল্য ছাড়াই উৎসবে অংশ নিতে পারএইবেন। আসুন, মানুষের দৃঢ়তা, সাহস ও এগিয়ে যাওয়ার গল্পে আপনার স্বপ্ন জয়ের অনুপ্রেরণা খুঁজে নিন। সবার জন্য শুভ কামনা! এগিয়ে যাক বাংলাদেশ!

Leave a Reply

Your email address will not be published.