শরিফুল হাসান
অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডিকে কি আপনারা চেনেন? রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘটু গ্রামের এই দুই সাওতাঁল কৃষক গেল মার্চে সেচের পানি না পেয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেন। কারণ ধানের জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেলেও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত দুই কৃষককে পানি দেননি।
আসলে বরেন্দ্র অঞ্চলে একদিকে যেমন তীব্র পানির সংকট আছে আরেকদিকে এই সংকট ঘিরে আছে বানিজ্য। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কৃষকরা জমি বর্গা নিয়ে দিনের পর দিন পানির জন্য ঘোরেন। অভিনাথ ও রবি এভাবে ১২ দিন ঘুরতে ঘুরতে অসহায় অবস্থায় অপারেটরকে বলেন, পানি না পেলে আত্মহত্যা করবেন।
অপারেটর বলেন তোদের আত্মহত্যাই করা উচিত! মনের দুঃখে সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ ও তাঁর চাচাতো ভাই রবি ২৩ মার্চ বিষপান করেন। অভিনাথ সেদিন রাতেই মারা যান। আর রবি এক দিন পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দুঃখজনক ঘটনা হলো পানি না পেয়ে বিষপানে মৃত্যুর ঘটনাকেও দুই কৃষক চোলাই মদ পান করে মারা গেছেন বলে প্রচার চালানো হচ্ছিল।
তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তাঁদের বিষক্রিয়ায় মারা যাওয়ার কথা বলা হয়। এরপর পুলিশ তদন্ত করে জানায়, সেচের পানি না পাওয়ায় দুই কৃষক বিষপানে আত্মহত্যা করেন।ঘটনার পরপরই আমি অভিনাথ ও রবিদের বাড়িতে যাই। অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রমসহ পরিবার ও সাওতাঁলদের সঙ্গে কথা বলি। বরেন্দ্র অঞ্চলেরর এই পানি সংকট বুঝতে দুদিন আগেও রাজশাহী গিয়েছি। নানাজনের সঙ্গে কথা বলেছি। এই পানি সংকট নিয়ে আরেকদিন লিখবো। আজকে যে কারণে লিখছি সেটা হলো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই থাকেন রাজশাহী অঞ্চলে।
কিন্তু সমতলের এই জনগোষ্ঠীর কথা আমরা প্রায় ভুলেই থাকি। তাদের বাস্তব অবস্থা দেখলে আমরা বুঝতে পারবো এই বাংলাদেশের উন্নয়নের তুলনায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা বিশেষ করে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা কী ভয়াবহ পিছিয়ে আছে! আপনাদের কখনো সময় হলে তাদের অবস্থা ঘুরে দেখে আসবেন।একইরকম বা এর চেয়ে কম-বেশি দুরাবস্থায় আছে বাংলোদেশের চা শ্রমিকরা।
এই ২০২২ সালে এসেও চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা। সেই মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে ৯ আগস্ট থেকে আন্দোলন করছেন সারা দেশের চা-শ্রমিকেরা। এরপর কয়েক দফায় মালিকপক্ষ, প্রশাসন ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি তিন পক্ষ। গত শনিবার সরকারের পক্ষ থেকে ১৪৫ টাকা মজুরির সিদ্ধান্ত জানানো হলেও সাধারণ শ্রমিকেরা সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে। চা–শ্রমিকেরা যখন দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন, ঠিক তখন মালিকেরা বলছেন, তাঁরা নাকি চা–শ্রমিকদের ৪০২ মজুরি দেন।
আমার কাছে এটি একেবারেই যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি।আমি একাধিকবার একাধিক চা বাগানে গিয়েছি। চা শ্রমিক, তাদরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের জীবন দেখে ভীষণ মায়া হয়। একই অবস্থা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেক মানুষের। দেশের বিভিন্ন চরে বা অবহেলায় এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে। আসলে একদিকে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, আরেকদিকে সেই দেশেরই একদল মানুষ দিনে ৩০০ টাকা মজুরির জন্য আন্দোলন করছে, সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করছে, জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকতে লড়াই করছে। তাদের ভূমির অধিকার নেই, নেই মর্যাদাপূর্ণ একটা জীবন।
আমি মনে করি এগুলো আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার। একটা টেকসই বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের সবার কথা ভাবতে হবে। সবাইকে নিয়ে আগাতে হবে। আর তাই শুধু ৩০০ টাকা নয়, চা শ্রমিকদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবন চাই, চাই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য, চাই এই বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের জন্য। আসলে মাথাপিছু আয়ের হিসেবের চেয়েও প্রতিটা মাথা আর সেই মাথার নিচের প্রতিটা মানুষের কথা ভাবতে হবে।


