শরিফুল হাসান
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের ধর্মঘটের কারণে চরম সংকটে পড়েছেন বিদেশগামী কর্মীরা। সময়মতো বহির্গমন ছাড়পত্র না পেয়ে অনেকে নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট ধরতে পারছেন না। জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা এই কাজটি করে দিতেন। ধর্মঘটের আগে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার কর্মীকে ছাড়পত্র দেওয়া হতো। কিন্তু ৮ এপ্রিল ধর্মঘট শুরুর পর থেকে এই সংখ্যা সাত শর নিচে নেমে আসে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কাছ থেকে কর্মীরা নিজেদের উদ্যোগে এখন এই ছাড়পত্র নিচ্ছেন।বিএমইটির কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তাঁরা সকাল নয়টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করছেন। এ পর্যন্ত ১৮টি সেবা কাউন্টার করা হয়েছে। এর পরও সেবা না পেয়ে প্রতিদিন হইচই, গন্ডগোল হচ্ছে। পুলিশ দিয়ে এখন পরিস্থিতি সামলাতে হচ্ছে।বায়রার নেতারা দাবি করছেন, বিদেশগামীদের দুর্ভোগের বিষয়টি বুঝতে পেরে তাঁরা গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে ধর্মঘট স্থগিত করেছেন। তবে সরকার তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় না বসলে তাঁরা আবার ধর্মঘটে যাবেন। প্রাপ্ত হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে এবার সার্বিক জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। গত বছরের প্রথম তিন মাসে বিদেশে গিয়েছিলেন এক লাখ ৮৬ হাজার ২৮১ জন। কিন্তু এ বছরের প্রথম তিন মাসে বিদেশে গিয়েছেন এক লাখ সাত হাজার ৬২৮ জন। অর্থাৎ গত তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮০ হাজার লোক কম গেছেন। গত বছরের এপ্রিলে গিয়েছিলেন ৬৩ হাজার ১৭৫ জন। ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত গেছেন মাত্র ১৫ হাজার।গতকাল বিএমইটিতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক হাজার লোক বিশৃঙ্খলভাবে অপেক্ষা করছেন। বহির্গমন ছাড়পত্র জমা নেওয়ার কাউন্টারগুলোর সামনে হইচই। কর্মীরা অভিযোগ করছেন, ঘুষ নিয়ে কর্মচারীরা লাইন ভেঙে পেছনের লোককে আগে আনছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিএমইটিতে আনসারের পাশাপাশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাইফুল ইসলাম বলেন, ১৫ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে যাওয়ার ছাড়পত্রের আবেদন করেছিলেন। তিন দিনেও পাননি। আজ তাঁর ফ্লাইট, কিন্তু যেতে পারছেন না। সোহাগ রানা জানান, ওমানে যাওয়ার ছাড়পত্র নিতে তিন দিন আগে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছেন। দুই দিন আগে জমা দিলেও গতকাল পর্যন্ত তিনি ছাড়পত্র পাননি।নূরুন্নবী এসেছেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে। তিনি ১৬ এপ্রিল আবেদন জমা দিলেও ছাড়পত্র পাননি। কবে পাবেন জানেন না। ওমানগামী যশোরের রুহুল আমিন, চট্টগ্রামের হেলালউদ্দিন, বাসু নাথ, আলমগীর, ভোলার কবীর হোসেনসহ আরও অনেকেই একই অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলছেন, ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য এভাবে দিনের পর দিনে ঢাকায় পড়ে থাকায় তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।বাংলাদেশ থেকে যাঁরা বিদেশে যান, তাঁদের বেশির ভাগই আত্মীয়স্বজন বা ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে ভিসা আনেন। তবে তাঁদের বহির্গমন ছাড়পত্র নেওয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রমের প্রক্রিয়া করে দেয় বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, বায়রা ধর্মঘট ডাকতে পারে, আগে থেকেই এমন ধারণা থাকায় বিদেশগামীরা যেন সংকটে না পড়েন, সে জন্য নতুন সাতটি কাউন্টার করে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে বিএমইটি। এরপর আরও ১১টি কাউন্টার খোলা হয়। কিন্তু স্বাভাবিক সেবা পাননি বিদেশগামীরা। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, ধর্মঘটের আগের দিন ৭ এপ্রিলও দুই হাজার ১২৮ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ধর্মঘট শুরুর পর ৯ এপ্রিল ৬৮৪ জন এবং ১০ এপ্রিল ৬৭১ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া সম্ভব হয়। কাউন্টারের সংখ্যা আরও বাড়ানোর পর ১১ এপ্রিল এক হাজার ৮৮ জন, ১৫ এপ্রিল ৮৮১ জন, ১৬ এপ্রিল এক হাজার ৩৪৯ জন ছাড়পত্র পেয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত কর্মকর্তারা কাজ করার পর ১৭ এপ্রিল এক হাজার ৭২১ জন, ১৮ এপ্রিল এক হাজার ৯০৪ জনের ছাড়পত্র দিতে পেরেছেন। বিএমইটির কর্মকর্তারা বলছেন, আগে হয়তো ২০০ লোকের আবেদন পূরণ করে টাকা জমা দিয়ে নিয়ে আসত কোনো একটি রিক্রুটিং এজেন্সি। ফলে খুব সহজেই কাজ করা যেত। কিন্তু এখন ২০০ জনই আলাদা আলাদা করে আবেদন করছেন। ফলে কাজ বেড়ে গেছে বহু গুণ। এ ছাড়া নামের বানান, পাসপোর্ট নম্বর ইত্যাদি ভুল করায় সংকট আরও বাড়ছে। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত কাজ করেও তাঁরা শেষ করতে পারছেন না। বিএমইটির পরিচালক মিজানুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার লোক ছাড়পত্র নিতে আসছেন। তাঁদের সবার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে হয়। এরপর ডেটাবেজে নাম অন্তর্ভুক্ত করে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হচ্ছে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো করছি।’আলোচনা চায় বায়রা, না সরকারের: বায়রার নেতারা বলছেন, সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর বিরোধী তাঁরা নন। তবে অন্যান্য বাজারে সরকার তাঁদের সহায়তা করছে না। গত বছর বায়রার বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হওয়ার পর তারা তিনবার মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মন্ত্রী তাদের সময় দেননি। ফলে সদস্যদের চাপেই বায়রাকে ধর্মঘটে যেতে হয়েছে।বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশগামী শ্রমিকেরা যে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়েছেন, সেটি বুঝতে পেরেছি বলেই আমরা কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক করে ধর্মঘট স্থগিত করেছি। কিন্তু সরকার আমাদের দুর্বল ভেবে মামলা দিচ্ছে। তবে এমন পরিস্থিতিতেও মন্ত্রী যদি আলোচনায় বসতে চান, আমরা রাজি আছি।’ প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়রার ধর্মঘটে জনশক্তি রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সব ব্যবস্থা নিয়েছি।’ আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়।’প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী গতকাল সকালেই একটি সম্মেলনে যোগ দিতে বুদাপেস্টে গেছেন। ধর্মঘট স্থগিতের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণসচিব জাফর আহমেদ খান বলেন, ‘বায়রার যে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ। আমরা চাই ভবিষ্যতেও তারা মানুষের কথা বুঝবে। কারণ, সাধারণ মানুষ যাতে প্রতারিত না হয়, সে কারণেই আমরা সরকারিভাবে লোক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি।’জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘মন্দা ও কয়েকটি বাজারে সংকটের কারণে এই পরিস্থিতি। তবে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার ঠিক হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সমন্বয়ক সি আর আবরার বলেন, সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছে, সেটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এতে বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, ‘তবে মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে লোক পাঠানোর উদ্যোগকে অবশ্যই আমরা সবাই স্বাগত জানাই। বায়রারও উচিত সরকারকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। আবার সরকারেরও উচিত অন্যান্য বাজারে বায়রাকে সহায়তা করা।’



