বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখা

Spread the love

যাচাই ছাড়া লোক নিয়োগ

শরিফুল হাসান


বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিভিন্ন দলিলপত্র ছাপা হয় বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখা থেকে। এ কারণেই পুলিশের গোপন প্রতিবেদন ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে ওই শাখায় নিয়োগের নিয়ম নেই। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যাচাই না করেই কর্মচারীদের বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের সুপারিশ গুরুত্ব পেয়েছে।বিজি প্রেসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রথম আলোর কাছে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, অতীতে এ নিয়ম মানা হয়নি। মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তে বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষ যে কমিটি করেছে, সেই কমিটিও বিষয়টির সত্যতা খুঁজে পেয়েছে।তদন্ত কমিটির প্রধান মুদ্রণ, লেখসামগ্রী, ফরম ও প্রকাশনা পরিদপ্তরের পরিচালক আবুল কাশেম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালায় থাকলেও নানা কারণে এই নিয়ম মানা হয়নি। অনেক সময় প্রয়োজনের কারণে দিনে দুবারও গোপনীয় শাখার কর্মচারী বদলাতে হয়েছে। সময়স্বল্পতার কারণে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন থেকে যেন তা করা হয়, সেটি তাঁরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করবেন।বিজি প্রেসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অতীতে বিভিন্ন সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় ২০০০ সালে গোপনীয় শাখা পরিচালনার নীতিমালা করা হয়। কীভাবে গোপনীয় শাখায় কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হবে, প্রশ্নপত্র ছাপার সময় কে কী করবেন, কী পোশাক পরবেন, কীভাবে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হবে, সবই বলা আছে নীতিমালায়। এই নীতিমালা অনুযায়ী বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখার কার্যক্রম চলার কথা।ওই নীতিমালার ১-এর (ট) ধারায় বলা আছে, শুধু পুলিশ কর্তৃক চরিত্র যাচাইয়ের পরই কোনো কর্মচারীকে গোপনীয় শাখায় কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে। নীতিমালার ২-এর (ক) ধারায় বলা আছে, গোপনীয় শাখায় নিয়োগের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা ও নিষ্ঠা প্রধান যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। কারও সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন থাকলে কাউকে গোপনীয় শাখায় নিয়োগ করা যাবে না।তদন্ত কমিটির সদস্য এবং বিজি প্রেসের উপপরিচালক মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে একবার তাঁদের প্রতিবেদন নেওয়া হয়েছিল। তবে সময়স্বল্পতার কারণে গোপন শাখায় নিয়োগের সময় তাঁদের যাচাই করা যায়নি। এমনও হয়েছে, এক দিনে দুবার কর্মচারী বদলাতে হয়েছে। পুলিশের পক্ষে ওই কর্মচারীদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে এক দিনে যাচাইয়ের কাজ করাও সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে নীতিমালা মেনে যেন গোপনীয় শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়, সেটি তাঁরা প্রতিবেদনে বলবেন। আজ মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। এই কর্মকর্তা বলেন, গোপনীয় শাখার কর্মচারীদের দু-এক বছর পরপরই পুলিশ ভেরিফিকেশন হওয়া উচিত। এতে তাঁদের সম্পদ ও অন্যান্য কার্যক্রমের বিষয়গুলো বেরিয়ে আসবে।নীতিমালার ১-এর (ছ) ধারায় বলা আছে, গোপনীয় শাখার কার্যক্রম চলাকালে শাখার কর্মচারীদের প্রতি দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নজর রাখবেন। কারও ব্যাপারে সন্দেহ হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবেন। এ ছাড়া ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে উপনিয়ন্ত্রক সারাক্ষণ গোপনীয় শাখার কার্যক্রম দেখবেন।তবে বিজি প্রেসের বর্তমান পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, একজন কর্মকর্তার পক্ষে সারাক্ষণ মনিটরে চোখ রাখা সম্ভব নয়। কারণ তাঁকে আরও অনেক কাজ করতে হয়।বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখার নীতিমালার ২(খ)তে বলা আছে, কর্মচারী ইউনিয়ন বা অন্য কোনো ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত কাউকে এই শাখায় নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এর বদলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা ও নিষ্ঠাই হবে প্রধান মানদণ্ড।তবে বিজি প্রেসের একাধিক কর্মচারী প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, কর্মচারী সমিতির নেতারা বরাবরই তালিকা তৈরি করে সুপারিশ পাঠান। সেই সুপারিশ অনুযায়ীই গোপনীয় শাখায় লোক নিয়োগ করা হয়।তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কর্মচারী সমিতির নেতারা। সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দাবি করে প্রথম আলোকে বলেন, ওই শাখায় নিয়োগ হয় গোপনীয় শাখার ইনচার্জের পরামর্শে। এ ক্ষেত্রে সমিতির নেতাদের কোনো সুপারিশ থাকে না।মোস্তফার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রতিমন্ত্রী: প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মোস্তফার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের বাড়িও একই জায়গায়।বিজি প্রেসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন এক বৈঠকে বিজি প্রেসের তৎকালীন উপপরিচালক মাছুম খান ও সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেনের কাছে এ টি এম মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রী লাবণী বেগমের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। তিনি তাঁদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষকে বলেন। গোপনীয় শাখার কর্মচারীদের একটি তালিকাও চেয়ে পাঠান।বিজি প্রেসের নথিপত্র অনুযায়ী ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ে গোপনীয় শাখার কর্মচারীদের তালিকা পাঠানো হয়।ওই বৈঠকের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিজি প্রেসের সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যত দূর মনে পড়ে, প্রতিমন্ত্রী মহোদয় কারও নাম উল্লেখ করেননি। তিনি বলেছিলেন, বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত।’তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁদের আগে জানা ছিল না। তবে তদন্ত করতে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, প্রতিমন্ত্রী সে সময় এ টি এম মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ওই বৈঠকের পর বিজি প্রেস থেকে একটি তালিকাও প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়।পুরোনো মেশিনের কারণে যত সমস্যা: বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখায় ছাপার কাজ চলে পুরোনো যন্ত্রে। বর্তমানে সেখানে অলিভার-৬৬ ও অলিভার-৭২ মেশিনে ছাপার কাজ হয়। এগুলো ২৫-৩০ বছরের পুরোনো।বিজি প্রেসের উপপরিচালক প্রথম আলোকে জানান, পুরোনো দিনের এসব যন্ত্রে কাজ করতে অনেক লোক লাগে। গোপনীয় শাখায় লোক যত বেশি হয়, নিরাপত্তাঝুঁকিও তত বাড়ে। এত লোকের ওপর নজরদারি করা কঠিন। নতুন মেশিন এলে এই সমস্যা কমবে।নিরাপত্তায় ত্রুটি: বিজি প্রেসে মোট চারটি গেট রয়েছে। নীতিমালার ১-এর (গ) অনুযায়ী বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখা থেকে বের হওয়ার সময় প্রতিদিন নিরাপত্তামূলক সিলগালা করা তালা দিয়ে গোপনীয় শাখা বন্ধ করতে হবে। ওই তালার চাবি থাকবে শাখা সুপারভাইজার ও নিয়ন্ত্রকের কাছে। পরদিন সিলগালা পরীক্ষা করে তালা খুলতে হবে। ১(ঘ) ধারায় বলা আছে, গোপনীয় শাখার কাজ চলার সময় প্রথম গেটটি সার্বক্ষণিকভাবে তালাবদ্ধ থাকবে এবং সেখানে একজন দারোয়ান সার্বক্ষণিকভাবে পাহারায় থাকবেন। দ্বিতীয় গেটে একজন পুলিশ ও একজন দারোয়ান থাকবেন। তাঁরা শাখার অভ্যন্তরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার সময় তল্লাশি করবেন। ১-এর (ছ) ধারায় বলা আছে, গোপনীয় শাখার কার্যক্রম চলাকালে শাখার কর্মচারীদের প্রতি দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নজর রাখবেন।বিজি প্রেসের উপপরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকায় নিরাপত্তা কার্যক্রমে দুর্বলতা ছিল। বিজি প্রেসে ১৪ জন পুলিশ সার্বক্ষণিক অবস্থান করার কথা থাকলেও অতীতে তা ছিল না। এর ফলে তল্লাশি কার্যক্রম ঠিকভাবে হয়নি।৩(ক) ধারায় বলা আছে, নিরাপত্তার স্বার্থে অন্য কোনো পোশাক পরে গোপনীয় শাখায় কেউ ঢুকতে পারবে না। এ জন্য এখানে সংরক্ষিত পোশাক পরতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার জন্য বাইরে থেকে বানানো বিশেষ পোশাক নেওয়া হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.