অনিশ্চয়তায় লিবিয়াফেরত ৩২ হাজার কর্মী-পরিবার
শরিফুল হাসান
বিদেশে গিয়ে ভাগ্য ফেরাবেন, এ আশায় জমিজমাসহ সর্বস্ব বিক্রি করে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় গিয়েছিলেন ফরিদপুরের সুজাত মিয়া। কিন্তু মাত্র নয় মাসের মাথায় তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সুজাত মিয়ার এখন দিশেহারা অবস্থা। লিবিয়া থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে সুজাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘খরচের অর্ধেক টাকাও তুলতে পারি নাই। দুই চোখে অন্ধকার দেখছি। সরকার যদি আমাকে দয়া করে একটা কাজ দিত, পরিবার নিয়ে বাঁচতাম।’কেবল সুজাত নয়, লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ৩২ হাজার বাংলাদেশির সবার কণ্ঠেই কমবেশি একই আহাজারি। প্রবাসীদের অভিযোগ, বিদেশ থেকে ঘাম ঝরানো টাকা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তাঁদের কথা কেউ ভাবে না। সবাই শুধু বড় বড় কথা বলে।কেবল লিবিয়াফেরত নয়, এর আগে যাঁরা বিদেশ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে ফেরত এসেছেন, তাঁদেরও একই অভিযোগ। বিশ্বমন্দার কারণে ২০০৯ সালে ৭২ হাজার ২১০ জন এবং ২০১০ সালে ৪৩ হাজার ৫০৩ জন কর্মী বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন। তাঁদের জন্যও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু করা হয়নি। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বমন্দার সময়ে ফেরত আসা প্রবাসীদের আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনা দেওয়ার জন্য আমরা সরকারের কাছে বারবার দাবি জানিয়েছিলাম। ৫০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি। ফিরে আসা প্রবাসীদের বেশির ভাগই এখন নিঃস্ব। অনেকে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন বলেও আমরা জানি।’লিবিয়া থেকে ফেরত আসা প্রবাসীদের নিয়ে সরকার কিছু ভাবছে কি না, জানতে চাইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ফেরত আসা কর্মীদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ফিরে আসা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ব্যবসা করতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক থেকে তাঁদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর ভবিষ্যতে বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে লিবিয়াফেরত বাংলাদেশিরা অগ্রাধিকার পাবেন।ফেরত আসা ব্যক্তিদের সহায়তা করা প্রসঙ্গে বায়রার বর্তমান সভাপতি আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া বা সৌদি আরবে বাজার চালু হলে এঁদের কাছ থেকে কম টাকা নিয়ে সেখানে পাঠানো যেতে পারে।’তবে মন্ত্রী বা বায়রার মহাসচিবের এসব কথায় আশ্বস্ত নন প্রবাসীরা। তাঁরা বলছেন, দেশে ফেরার পর সরকারের কেউ তাঁদের খোঁজখবর নেয়নি। ভবিষ্যতে কিছু করা হবে এমন কথাও এ পর্যন্ত তাঁদের কেউ বলেনি।দিশেহারা প্রবাসীরা: টাঙ্গাইলের নিজামউদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, জমিজমা বিক্রি করে দুই লাখ টাকা খরচ করে গত বছর লিবিয়া গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন কয়েক বছর থেকে সব দেনা শোধ করে পরিবারে সচ্ছলতা আনবেন। কিন্তু এখন খেয়ে-পরে বাঁচবেন কি না তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন।কুমিল্লার দেবীদ্বারের বেলাল হোসেন বলেন, ‘সবার আশা ছিল লিবিয়া গিয়ে আমি সংসারের হাল ধরব। কিন্তু আমি এখন উল্টো পরিবারের বোঝা হয়ে গেছি। বেঁচে থাকার উৎসাহও হারিয়ে ফেলছি। ’হবিগঞ্জের নজরুল চৌধুরী বলেন, ‘এক বছরে যা রোজগার করেছি তার কিছুই আনতে পারি নাই। দুইটি মোবাইল ও হাতে যে টাকা ছিল তা পথে লুট হয়েছে। পরিবারকে বাঁচাতে হলে ভিক্ষা করা ছাড়া আমার গতি নেই।’চাঁদপুরের মোহাম্মদ শাহিন, নরসিংদীর মোহাম্মদ আলম, শেরপুরের সামিউল হক, মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ টিপু, নোয়াখালীর মোহাম্মদ হোসেন, সিলেটের শাহাবুদ্দিন, ময়মনসিংহের আবদুল মজিদ, গাজীপুরের আলমগীর হোসেন, ভৈরবের সাখাওয়াত হোসেনসহ বেশ কয়েকজন প্রবাসী জানিয়েছেন একই কষ্টের কথা। দেশে ফিরে প্রবাসীরা ‘লিবিয়া কল্যাণ সমিতি’ ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে বকেয়া বেতন পরিশোধ, লিবিয়া সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়েছেন।কথা অনেক, উদ্যোগ নেই: ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে গতকাল ২৭ মার্চ পর্যন্ত ৩২ হাজার ৩৭৬ জন প্রবাসী লিবিয়া থেকে ফেরত এসেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু শোনেননি। তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বায়রা ও ব্যবসায়ী নেতাসহ অনেকে সভা-সেমিনারে ফেরত আসা প্রবাসীদের সহায়তা করার কথা বলছেন। লিবিয়াফেরতদের জন্য সরকারের কোনো উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ সচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাঁদের জন্য কিছু করতে চাই। আমাদের এ ব্যাপারে নিজস্ব ভাবনা আছে। তবে এখনো তো তাঁদের আসা শেষ হয়নি। একটু সময় লাগবে।’ কল্যাণ তহবিল হয়েও লাভ নেই: প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের কল্যাণের জন্য ১৯৯০ সালে সরকার ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল গঠন করে। বিদেশগামী কর্মীদের এই তহবিলে যাওয়ার আগে মাথাপিছু দেড় হাজার টাকা করে দিতে হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত কল্যাণ তহবিলে জমা পড়েছে ৬৪২ কোটি চার লাখ ৯৬১ টাকা। এর থেকে মূলত লাশ পরিবহন ও দাফনে খরচ হয়েছে আড়াই শ কোটি। সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছরই গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু লাশ না হয়ে ফিরলে কল্যাণ তহবিল থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যায় না।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কল্যাণ তহবিলের কিছু টাকা প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে গেছে। বিদেশ থেকে লাশ আনা, বিদেশের জেল থেকে কর্মী ফেরত আনাসহ অনেক কাজে এই টাকা খরচ হয়। এখান থেকে এ মুহূর্তে বিদেশফেরতদের সহায়তা করা কঠিন। তবে সরকার প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক বা অন্য কোনো মাধ্যমে তাঁদের ঋণ সহায়তা দেবে। এ ছাড়া কর্মীরা যেন কোম্পানিগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ পায় সে বিষয়টিও দেখা হবে।সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান: প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আইএমএআরএফের (ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্র্যান্টস অ্যালায়েন্স রিসার্চ ফাউন্ডেশন) জাতীয় সমন্বয়ক আনিসুর রহমান খান প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন যাতে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা, ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা ও দেশেই আবার কর্মসংস্থানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আইএমএআরএফ সমন্বয়ক বলেন, এ জন্য সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যবসায়ী—সবাই এগিয়ে আসতে পারেন। বায়রার সভাপতি আবুল বাশার বলেন, ‘আমরা এফবিসিসিআই, বিজিএমইএসহ সবার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলছি। আমরা বলেছি বিদেশফেরত এই লোকগুলোকে কাজে লাগাতে।’ বায়রার সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় যাঁরা দেশে ফিরেছিলেন তাঁরা সবাই তিন লাখ করে টাকা পেয়েছিলেন। কাজেই সরকারের উচিত এখনই জাতিসংঘে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করে রাখা।অভিবাসনবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা রামরুর সমন্বয়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা করার এখনই করতে হবে। কারণ কিছুদিন পরই হয়তো তাঁদের কথা মানুষ ভুলে যাবে। রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তবে একটা সময়সীমা ঠিক করে কর্মপন্থা করা উচিত।’



