নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলা বাল্কহেড ধাক্কা দিল লঞ্চকে

Spread the love

মধ্যরাতে মেঘনায় আতঙ্ক

শরিফুল হাসান

মেঘনা নদীতে গত বৃহস্পতিবার রাতে বাল্কহেডের সরাসরি আঘাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত শরীয়তপুর থেকে ঢাকাগামী লঞ্চ রেডসান-২। অল্পের জন্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় এর দেড় শ যাত্রী l প্রথম আলো
মেঘনা নদীতে গত বৃহস্পতিবার রাতে বাল্কহেডের সরাসরি আঘাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত শরীয়তপুর থেকে ঢাকাগামী লঞ্চ রেডসান-২। অল্পের জন্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় এর দেড় শ যাত্রী l প্রথম আলো

শরীয়তপুরের নড়িয়া থেকে ছেড়ে আসা এমভি রেডসান-২ নামের লঞ্চটি মেঘনা নদী দিয়ে এগোচ্ছিল ঢাকার দিকে। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তখন একটা। শীতের মধ্যরাতে লঞ্চের অধিকাংশ যাত্রী তখন ঘুমে। হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কা ও বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে তাঁদের। ঘটনা বুঝতে গিয়ে তাঁরা দেখলেন, বালু বহন করা বিপরীতমুখী একটি নৌযান (বাল্কহেড বা বলগেট) লঞ্চের পেছনের অংশে ধাক্কা দিয়েছে। যাত্রীদের মধ্যে শুরু হয় লঞ্চডুবির আতঙ্ক, কান্না-চিৎকার।
তবে গজারিয়ার কাছাকাছি মেঘনার বুকে ওই লঞ্চের শতাধিক যাত্রীর প্রাণ বেঁচে গেছে লঞ্চচালকের দক্ষতায়। বাল্কহেডের ধাক্কায় লঞ্চের দোতলার ডেকের চারজন যাত্রী আহত এবং ডেকের এক পাশ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাতে চলাচলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলা মেসার্স ঝমঝম নেভিগেশনের ওই বাল্কহেড দ্রুতগতিতে পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। লঞ্চের কয়েকজন যাত্রী বাল্কহেডে নেমে রশি দিয়ে সেটিকে বেঁধে ফেলেন লঞ্চের সঙ্গে। লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাটে ভেড়ার আগ পর্যন্ত বাকি সময় যাত্রীদের কাটে তীব্র আতঙ্কে। কারণ, ২০১২ সালের ১২ মার্চ রাতে মেঘনাতেই এমন নৌযানের ধাক্কায় এমভি শরীয়তপুর লঞ্চ ডুবে প্রাণ হারান ১৪৭ জন। ওই ঘটনার পর রাতে এই নদীপথে পণ্য ও বালুবাহী নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলছে পণ্যবাহী নৌযান।
নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বলেছে, মেঘনা নদী দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৯০ হাজার মানুষ দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন পথে চলাচল করে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে বাল্কহেডসহ পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকে যাত্রীরা। নৌপুলিশ বলেছে, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করা নৌযানের বিরুদ্ধে তারা মাঝেমধ্যেই রাতে অভিযান চালায়। কাউকে পেলে জরিমানা করে।
এমভি রেডসান-২ লঞ্চটি নড়িয়া থেকে ছেড়েছিল বৃহস্পতিবার রাত নয়টায়। পৌরসভা নির্বাচনের খবর সংগ্রহ শেষে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক ও একজন ফটোসাংবাদিকও ছিলেন এই লঞ্চের যাত্রীদের মধ্যে। অন্ধকার ও কুয়াশা কেটে ঢাকার দিকে এগোচ্ছিল লঞ্চ। হঠাৎ বিপরীতমুখী বাল্কহেড যাত্রীদের সব স্বস্তি কেড়ে নেয়। ঘটনা সম্পর্কে এমভি রেডসান-২-এর মাস্টার মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘন কুয়াশা ছিল। সার্চলাইট, হর্ন ও মাইক ব্যবহার করে আমরা স্বাভাবিকভাবে চলছিলাম। রাত একটার দিকে সামনে একটা বাল্কহেডের মতো চোখে পড়ে। এগুলোর বাতি থাকে না বলে দূর থেকে বোঝা যায় না। কাছাকাছি আসার পর আমি বারবার হর্ন দিই ও মাইকে বাল্কহেডটিকে সরে যেতে বলি। কিন্তু সেটি এগিয়ে এসে লঞ্চের নিচে ঢুকে গিয়ে পেছনের অংশে ধাক্কা দেয়। সতর্ক থাকার কারণে আমরা দ্রুত লঞ্চটি সরিয়ে আনতে পেরেছি। তারপরও লঞ্চের পেছনের অংশ দুমড়েমুচড়ে গেছে।’
দোতলার ডেকে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীরা কেউ কাঁদছেন, কেউ আত্মীয়স্বজনকে ফোন করে ঘটনা জানাচ্ছেন। বাল্কহেডের ধাক্কায় দোতলার ডেকে থাকা যাত্রী সেলিনা আক্তার (১৫) ও তার বোন আমেনা আক্তার (৮) আহত হয়েছে। তাদের মা মাকছুদা বেগম ভয়ার্ত কণ্ঠে বারবার বলছিলেন, ‘আল্লাহ বাঁচাইছে। আমার মেয়ে দুইটারে আল্লাহ বাঁচাইছে।’ মাকছুদার ভাই জাহাঙ্গীর সরদারও (৪৫) আহত হয়েছেন। পুরো ঘটনায় তিনি হতবিহ্বল। কুদ্দুস নামের আরেক যাত্রীর মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রী মাসুদ আল আমিন বলেন, ‘বাল্কহেডটা এসে সোজা লঞ্চের পেছনে ধাক্কা দিল। আরেকটু হলে ছোট কয়েকটি বাচ্চাকে পিষে ফেলত। যেভাবে বাল্কহেডটা ধাক্কা মেরেছে, তাতে ছোট লঞ্চ হলে ডুবেই যেত। লঞ্চের মাঝখানে ধাক্কা লাগলে হয়তো আমরা সবাই ডুবে মরতাম।’
মোহাম্মদ কুদ্দুসসহ লঞ্চের অন্তত ২৫ যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বছর তিনেক আগে কার্গোর আঘাতে গজারিয়ায় লঞ্চডুবিতে শরীয়তপুরের প্রায় দেড় শ জন মারা যান। যে কার্গোগুলোর রাতে চলাচলের কারণে যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে, এগুলোকে কঠিন শাস্তি দেওয়া দরকার।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মেসার্স ঝমঝম নেভিগেশনের ওই বাল্কহেডের মাস্টার মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার গাবতলী থেকে তাঁরা বালু আনতে ভোলার মনপুরায় যাচ্ছিলেন। ঘন কুয়াশা ও অন্ধকারের কারণে লঞ্চটা আগে দেখতে পাননি। শেষ মুহূর্তে দেখে ইঞ্জিন নিউট্রাল করার চেষ্টা করেছিলেন। রাতে চলাচল নিষিদ্ধ হলেও চালাচ্ছেন কেন, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাতে না চালালে ট্রিপ বেশি মারা যায় না। আর ট্রিপ না মারতে পারলে আমরা চলতে পারব না। কারণ, একটা ট্রিপ মারলে মাত্র চার-পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া যায়।’
জানতে চাইলে নৌপুলিশের অতিরিক্ত সুপার মো. হাতেম আলী বলেন, ‘রাতে এসব কার্গোর চলাচল নিষিদ্ধ। তারপরও অনেকে আইন ভেঙে চলে। আমরা এসব বন্ধে মাঝেমধ্যেই রাতে অভিযান চালাই। কাউকে পেলে জরিমানা করি।’ এ পর্যন্ত কতজনকে জরিমানা করা হয়েছে বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, সেই হিসাব সুনির্দিষ্টভাবে বলতে সময় লাগবে।

বাল্কহেডের আঘাতে লঞ্চ রেডসান-২-এর ডেকে থাকা শিশুসহ কয়েকজন আহত হয়। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে l প্রথম আলো
বাল্কহেডের আঘাতে লঞ্চ রেডসান-২-এর ডেকে থাকা শিশুসহ কয়েকজন আহত হয়। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে l প্রথম আলো

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির উপদেষ্টা লুৎফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোর জন্য একটা বড় ঝুঁকি মালবাহী নৌযান। রাতে নিষিদ্ধ থাকলেও এগুলো চলছে। ফলে ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চগুলোকে চলতে হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে আমাদের অনুরোধ, সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত যেন এগুলো চলতে না পারে, সে ব্যাপারে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাল্কহেডগুলো অবাধে রাতে চলাচল করে। ফলে ঢাকায় প্রতিদিন যাওয়া-আসা করা ৯০ হাজার মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। বিআইডব্লিউটিএ বা সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, কোনোভাবেই যেন রাতে বাল্কহেড চলতে না পারে, সে জন্য পুলিশ ও কোস্টগার্ডকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। কারণ, এই বাল্কহেডগুলোর বেশির ভাগ অংশ থাকে পানির নিচে। সেগুলোর বাতিও থাকে না। ফলে যাত্রীবাহী লঞ্চ ঝুঁকিতে থাকে। আর এগুলোর বেশির ভাগেরই নিবন্ধন নেই। কাজেই এদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.