শরিফুল হাসান
টিনের ঘরের বেড়াটি কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করা। আর ঘরের ভেতর পুরো তছনছ। ছড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা আসবাব, হাঁড়িপাতিল, এমনকি বহু যত্নেরœ হারমোনিয়ামটিও। বঙ্গবন্ধুর দুটি ছবিও দলাইমলাই করা।
এসব দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধা পূর্ণিমা দাস বললেন, ‘ওরা দল বেঁধে আইছে। তছনছ কইরা দিছে। বাড়িতে রাখা আমার পুলার বউয়ের দুই ভরি স্বর্ণসহ বাড়ির সব দামি জিনিসপত্র লুট কইরা নিছে। আমার দুই বছরের নাতিটা তখন ভয়ে কাঁপতাছে। কেউ একজন তহন কইলো, এইটারে জবাই কর। আমি হেরার কাছে কাকুতি মিনতি করলাম। কেউ একজন তহন কইলো, কানের দুলটা খুইল্যা দে। আমি ভয়ে ভয়ে দিয়া দিছি। আমি গান গাইতাম। যাইবার আগে হেরা আমার হারমোনিয়ামটা ভাইঙা গুঁড়াইয়া দিয়া গেছে। আমি আমার ৫৫ বছরের জীবনে এমন তাণ্ডব দেখছি না।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার কাশিপাড়া গ্রামে গতকাল দুপুরে কথা হচ্ছিল পূর্ণিমা দাসের সঙ্গে। তছনছ করা ভাঙা ঘর দেখাতে দেখাতে পূর্ণিমা যখন কথা বলছিলেন, পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন তাঁর স্বামী অমূল্য দাসও। এই দম্পতি আফসোস করে বললেন, ঘটনার তিন দিন হয়ে গেলেও এখনো তাঁদের কেউ কোনো সাহায্য করতে আসেনি। তাঁদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি।
অমূল্য আর পূর্ণিমার মতো একই আফসোসের কথা জানালেন কাশীপাড়ার অরুণ সূত্রধর, গোপাল দাস, নেপাল সূত্রধর, গীতা রানী, কীরেন্দ্র দাস, শ্রীবাস সূত্রধরসহ আরও অনেকে। অবশ্য শুধু কাশীপাড়াতেই নয়, পূর্বপাড়া, ঘোষপাড়া, নমশূদ্রপাড়াসহ নাসিরনগর উপজেলার অর্ধশত হিন্দু পরিবারের ৭০-৮০ জনের সঙ্গে গতকাল সারা দিন কথা হয়েছে।
সেখানে তো পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। আমিই পুলিশ-বিজিবি পাঠিয়ে সব স্বাভাবিক করেছি
ছায়েদুল হক
সাংসদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বললেন, তাঁদের বাড়িঘর তছনছ ও লুটপাট করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় সাংসদ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক এক দিনের জন্যও এলাকায় আসেননি। আসেননি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক সাংসদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কিংবা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীও। এলাকায় না যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নাসিরনগরের সাংসদ ও মন্ত্রী ছায়েদুল হক গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেখানে তো পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। আমিই পুলিশ-বিজিবি পাঠিয়ে সব স্বাভাবিক করেছি।’ হিন্দুদের বাড়িঘরে লুটপাট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোথায় পেয়েছেন এসব তথ্য? কয়েকটি মন্দিরে হামলা ছাড়া কিছুই হয়নি।’
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীমের নেতৃত্বে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ-বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য গোলাম রাব্বানী, মারফা আক্তার এবং জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ঘটনাস্থলে যান। দুপুরে এনামুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘নাসিরনগরে যা ঘটেছে তা ন্যক্কারজনক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খোঁজ রাখছেন। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
স্থানীয় হিন্দুসম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, গতকাল জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ২৯টি পরিবারকে ৫ হাজার করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি মন্দিরকে ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। উল্টো রাতের বেলা হিন্দু এলাকাগুলোতে লোকজনকে নানাভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে। যেসব এলাকা হিন্দু-অধ্যুষিত, সেখানে রাতে টর্চের আলো ফেলাসহ বাড়াবাড়ি করলে আবার হামলা হবে—এমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
নাসিরনগর উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি আদেশ চন্দ্র দেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে কিছুটা সাহায্য করা হলেও বাকিরা আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। অথচ মানবতার স্বার্থেই এই মানুষগুলোর পাশে সবার দাঁড়ানো উচিত।’
গত রোববার ফেসবুকের একটি ছবিকে কেন্দ্র করে নাসিরনগরে হিন্দুদের ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়িতে হামলা হয়। এরপর পেরিয়েছে তিন দিন। তবে আতঙ্ক কাটেনি হিন্দুধর্মাবলম্বী লোকজনের।
এলাকার লোকজন বলছেন, নাসিরনগর সদরের যেসব এলাকায় হামলা হয়েছে, প্রায় প্রতিটিই থানা থেকে আধা কিলোমিটার থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে। হামলাকারীরা থানার সামনে এবং পেছন দিয়ে বিভিন্ন বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে। থানার সিসি ফুটেজে এসব থাকার কথা। কিন্তু সেগুলো ধরে পুলিশ এখনো কাউকে আটক করেনি। এ ঘটনায় দুটি মামলা হলেও নতুন করে কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
পাশে নেই কেউ: ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে নাসিরনগরের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। দুপাশের সবুজ ধানখেত, হাওর পেরিয়ে ছিমছাম শান্ত এই উপজেলায় এমন তাণ্ডব হতে পারে, সেটা গ্রামগুলোতে না ঢুকলে বোঝা যায় না। নাসিরনগরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ল দত্তপাড়ার দুর্গামন্দির। সেখানে ভাঙা প্রতিমার সামনে পুলিশি পাহারা। মন্দিরের পূজারি বলাই দত্ত বললেন, ‘রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় কয়েক হাজার লোক এসে হামলা চালাল মন্দিরে। আমরা তখন জীবন বাঁচাতে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।’ হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর দেখলাম ধ্বংসলীলা। তিন দিন পেরিয়ে গেলেও কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি।’
এখান থেকে একটু এগিয়ে গেলেই পশ্চিমপাড়ার জগন্নাথ মন্দির। এখানকার পুরোহিত নরেন্দ্র চক্রবর্তী বললেন, হামলাকারীরা মন্দিরের স্বর্ণ ও রুপা সব নিয়ে গেছে। চালিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। তিন দিন পেরিয়ে গেলেও কেউ সাহায্য করতে আসেনি।
কাশীপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল একই উঠানের ১২টি বাড়ির প্রায় সব কটিতে হামলার চিহ্ন। সেদিনের ঘটনার সম্পর্কে জানতে চাইলে অরুণা রানী বললেন, ‘যারা আইছিল, ওদের বয়স হবে ১৪-১৮ বছর। বাড়িতে আইয়্যা ভাঙচুর শুরু করছে। ভয়ে আমরা দরজা আটকাইয়া দিছিলাম। একসময়ে দরজা ভাইঙা ঢুইক্যা পড়ল।’ পাশের ঘরের গীতা রানী বলেন, ‘অনেক কষ্ট কইরা দেড় ভরি স্বর্ণ কিনেছিলাম। ওরা সব লুট করে নিয়ে গেছে। ১৫ হাজার জমানো টাকা ছিল। তা-ও নিয়ে গেছে।’ মনমোহন সূত্রধর জানালেন, তাঁর বাড়িতে একমাত্র সেলাই মেশিনটিও হামলাকারীরা নিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা করছি। তালিকা শেষ হলেই তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে।’ জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ২৯টি পরিবারকে গতকাল ৫ হাজার আর মন্দিরগুলোতে ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছে।
আতঙ্ক কাটেনি হরিণবেড়ে: যার ফেসবুকের ছবিকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা, সেই রসরাজ চন্দ্র দাসের বাড়ি হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে। গতকাল দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে জানা গেল, এখনো আতঙ্কে গ্রামের পুরুষেরা এলাকাছাড়া। এখানকার সর্বজনীন শিবমন্দির ও কালীমন্দিরের প্রতিমাসহ ছয়টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে গ্রামের অন্তত ২০টি পরিবারের বসতবাড়ি।
রসরাজ দাসের কাকি কবিতা দাস (৩৫) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘তিন দিন পর মঙ্গলবার দুপুরে বাড়িতে আইছি। ঘরে মালপত্রও নাই, কোনো খাওনও নাই। পুরুষরা কে কই আছে জানি না।’ গ্রামের ইউপি সদস্য প্রফুল্ল চন্দ্র দাস বলেন, ‘রোববারের হামলার সময় আমিও ভয়ে এলাকা ছেড়েছিলাম। পুরো গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুরুষরা বাড়ি ছেড়েছে। অসহায় মানুষগুলোর পাশে এখনো কেউ এসে দাঁড়ায়নি।’



