নানা বিড়ম্বনা, তবু প্রবাসে কাজের হাতছানি

Spread the love

শরিফুল হাসান

বিদেশে ভালো কাজ ভালো বেতন, স্বপ্নটা ছিল এমনই। ভিটেমাটি বিক্রি করে তাই ৯০ হাজার টাকা দালালদের হাতে তুলে দিয়ে লেবাননে পাড়ি জমান নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার একটি গ্রামের এক মেয়ে (২৫)। কিন্তু লেবানিজ গৃহকর্তার অত্যাচার-নির্যাতন সইতে না পেরে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় দেশে ফিরে আসেন তিনি। এরপর দীর্ঘদিন ধরে তিনি আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ছিলেন।তাসলিমা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলেও জীবন বাঁচেনি গাজীপুরের রাশিদা, ফরিদপুরের সখিনা ও কিশোরগঞ্জের বুবিয়ার। ভাগ্য বদলাতে বিদেশে গিয়ে তাঁরা দেশে ফিরেছেন লাশ হয়ে, কাঁদিয়েছেন পরিবারকে। গত এক বছরে এভাবে লাশ হতে হয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিক নারী-শ্রমিককে।কষ্টের এ গল্পের পাশাপাশি আছে সুখেরও গল্প। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন প্রায় দেড় লাখ নারী অভিবাসী। প্রবাসে কাজের হাতছানিতে পুরুষের পাশাপাশি তাঁরাও গিয়েছেন বিদেশে। নানা বিড়ম্বনা আর কষ্ট সহ্য করে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে তাঁরা কেবল পরিবারের সুখই ফেরাননি, জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।বাংলাদেশি অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বমসা) প্রকল্প পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, বিদেশে থাকা একজন পুরুষ নানাভাবে টাকা খরচ করেন। কিন্তু একজন মেয়ে সব সময় পরিবারের কথা ভেবে টাকা জমিয়ে রাখেন এবং তা দেশে পাঠান। কিন্তু বিদেশ যাওয়া থেকে শুরু করে বিদেশে থাকা পর্যন্ত ভয়াবহ সব ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয় নারীদের। এর মধ্যে কয়েকটি সমস্যা গুরুতর। বিশেষ করে লেবাননে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। অথচ সেখানেই সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারী-শ্রমিকদের জন্য ভালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। কাজেই বর্তমানে ২১ দিনের যে প্রশিক্ষণব্যবস্থা আছে, সেটিকে তিন মাস করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের মেয়েরা ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনসের মেয়েদের মতো দক্ষ হন। আবাসিক কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্র না থাকায় মেয়েদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি মেয়েদের অভিবাসন নিরাপদ করতে হবে। এ জন্য দেশে ও বিদেশে পর্যবেক্ষণব্যবস্থা বাড়াতে হবে।জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, সাম্প্রতিককালে নারী-কর্মীদের বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। পাশাপাশি নারী-কর্মীদের চাহিদাও বেড়েছে। এ কারণেই সরকার নিরাপদ নারী অভিবাসন নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। আগে প্রশিক্ষণ ছাড়াই মেয়েরা বিদেশে যেতেন। কিন্তু এখন প্রশিক্ষণ ছাড়া মেয়েদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে না। এর ফলে সমস্যা ও বিপদ অনেক কমছে। অন্য যেসব ছোটখাটো সমস্যা আছে, সেগুলোরও সমাধান করা হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার অনেক আন্তরিক।সমস্যা লেবাননে, দূতাবাসও নেই২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ২২ হাজার ২২৪ জন নারী-কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে শুধু লেবাননেই গেছেন ১৩ হাজার ৬২ জন। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। নেই কোনো শ্রম কর্মকর্তাও। ফলে লেবাননে নির্যাতিত নারীরা বিপদে পড়লে সহায়তার জন্য কোথাও যেতে পারেন না। বিভিন্ন নারী ও অভিবাসী সংগঠন লেবাননে বাংলাদেশের একটি দূতাবাস খোলার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।কুলছুম বেগম (ছদ্মনাম) নামের এক নারী-শ্রমিক গত বছর গিয়েছিলেন লেবাননে। তাঁর বাড়ি নওগাঁ জেলা সদরের সুলতানপুর গ্রামে। কুলছুমের ভাই এস এম আক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, যাওয়ার কিছুদিন পরই কুলছুম মুঠোফোনে তাঁকে জানান, লেবাননে পৌঁছার পর তিন দিন তিনি বিমানবন্দরে অর্ধাহারে পড়ে ছিলেন। এরপর কিছু লোক তাঁকে একটি বাসাবাড়িতে কাজ করানোর কথা বলে নিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। আক্তারুজ্জামান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বোন বলছিল, তাকে উদ্ধার করতে না পারলে সে আত্মহত্যা করবে।’মানিকগঞ্জের রিকশাচালক লাল মিয়ার স্ত্রী ডালিয়া (ছদ্মনাম) ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেবানন যান। লাল মিয়া প্রথম আলোকে জানান, দীর্ঘদিন স্ত্রী তাঁকে ফোনও করতে পারেননি। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন ফোন করে জানান, তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের নিরাপদ অভিবাসন কর্মসূচির সহায়তায় লেবানন থেকে এ পর্যন্ত কয়েকজন নারী দেশে ফিরেছেন। ওই কর্মসূচির সমন্বয়ক লায়লা আনজুমান প্রথম আলোকে জানান, লেবাননে বাংলাদেশি নারীদের নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। তাঁরা ফিরে এসে সেখানকার অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটি ভয়াবহ। অসংখ্য মেয়েকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে সেখানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছে। দূতাবাস না থাকায় ওই মেয়েরা সাহায্যের জন্য কোথাও যেতে পারছেন না।একই সমস্যা মধ্যপ্রাচ্যে১৯৯১ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ১৮ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩৫ হাজার ৬৩০ জন নারী-শ্রমিক দুবাই গেছেন। এ ছাড়া সৌদি আরবে ৩১ হাজার ২৬৩, লেবাননে ২৫ হাজার ৩৭১, কুয়েতে সাত হাজার ৬৫৭, জর্ডানে ছয় হাজার ৫০, মালয়েশিয়ায় ছয় হাজার ৪২৫, মরিশাসে চার হাজার ৩১১, ওমানে দুই হাজার ৬৯৩ এবং বাহরাইনে তিন হাজার ৪০৮ জন নারী-কর্মী গেছেন। অভিবাসী নারী সংগঠনগুলোর মতে, কুয়েত, জর্ডান, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে। সাম্প্রতিক সময় জর্ডানে এ সমস্যা বেড়েছে বলে জানান ব্র্যাকের লায়লা আনজুমান। তিনি জানান, ভালো চাকরির কথা বলে জর্ডানের পতিতালয়ে মেয়ে পাঠানোর মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটেছে।নীতিমালা মানছে না অনেকেইবিদেশে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর জন্য ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর একটি বিধিমালা জারি করা হয়। ওই বিধিমালায় বলা আছে, গৃহকর্মী হিসেবে কোনো নারী বিদেশে যেতে চাইলে তাঁর বয়স অন্তত ২৫ হতে হবে। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই এ নিয়ম মানা হচ্ছে না।অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করেন, এমন একটি বেসরকারি সংস্থার আইনজীবী গীতি ভদ্র প্রথম আলোকে জানান, ঢাকার মিরপুর এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারা আখতার লেবানন যাওয়ার আগে পাসপোর্ট জমা দেন রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সির কাছে। তখন পাসপোর্টে তাঁর জন্মতারিখ ছিল ১৯৮৮ সালের ৬ জুন। কিন্তু পাসপোর্ট করার পর দেখেন, তাঁর জন্মতারিখ দেওয়া হয়েছে ১৯৮২ সালের ৬ জুন। প্রায় ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটছে। বয়স ১৬ বা ১৭ কিন্তু পাসপোর্টে ২৫ বানিয়ে তাঁদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। অল্পবয়সী এই মেয়েরা বিদেশে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, পড়েন নানা বিপদে।নীতিমালায় বলা আছে, নারীদের জন্য সরকার অনুমোদিত সর্বোচ্চ ব্যয় ২০ হাজার টাকা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে মেয়েদের। গীতি ভদ্র জানান, এ ছাড়া নীতিমালায় নিরাপদ অভিবাসনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক মেয়েকে কাজের কথা বলে অন্যায় কাজের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ নীতিমালা ভঙ্গকারীরা শাস্তি পাচ্ছে না।কাজের নামে পাচারবিদেশে কাজ দেওয়ার কথা বলে নারী পাচারের ঘটনাও ঘটছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে। সম্প্রতি দুবাই থেকে এমন ২০ জন নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের সবার বাড়ি ঢাকার আশপাশে। তাঁদের একজন নিলুফা ইয়াছমিন (ছদ্মনাম) জানান, এক লাখ টাকা খরচ করে তিনি বাসাবাড়িতে কাজ করার জন্য দুবাই যান। কিন্তু দুবাই যাওয়ার পর তাঁকে একটি অফিসে নেওয়া হয়। পরে কয়েকজন লোক তাঁকে নিয়ে যায় এবং জানায়, তাঁকে কেনা হয়েছে। এর পরই শুরু হয় নির্যাতন। পরে তিনি পালিয়ে বাঁচেন। একই সমস্যা হচ্ছে জর্ডান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে।আটকে আছে মোবাইল প্রকল্পপ্রবাসী নারীরা যেন বিপদে পড়লেই দেশে সহায়তা চাইতে পারেন, সে জন্য দেশ থেকে তাঁদের একটি করে মুঠোফোন এবং বিদেশে পৌঁছানোর পর একটি করে সিমকার্ড দেওয়ার কথা ছিল। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রবাসীদের নিয়ে আয়োজিত একটি সংলাপ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এখন থেকে বিদেশগামী সব মেয়েকে একটি করে মুঠোফোন ও সিমকার্ড দেওয়া হবে, যাতে করে তাঁরা দেশে যোগাযোগ করতে পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিদেশগামী নারীরা সেই মুঠোফোন পাননি।বমসার প্রকল্প পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম জানান, বিদেশে যাচ্ছেন এমন মেয়েদের মুঠোফোন দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে নির্যাতনের হার অনেক কমে যেত, আর মেয়েরাও অনেক নিরাপদ বোধ করতেন। দেশে অনেক বড় বড় মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারে।চাই সচেতনতানারী-কর্মীদের বিদেশে চাকরিসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য বিএমইটি ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে বিএমইটি ভবনে ‘নারী অভিবাসী তথ্যকেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়েছে। এই কেন্দ্রের কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার প্রথম আলোকে জানান, নারী-কর্মীদের বিদেশে যাওয়ার জন্য বিএমইটি কিংবা জেলা কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ কার্যালয়ে গিয়ে নাম লেখাতে হবে। এরপর পাসপোর্ট করতে হবে। কাউকে পাসপোর্ট করার দায়িত্ব দিলে নিজের নাম, ঠিকানা, বয়স ও তথ্য মিলিয়ে নিতে হবে। যাওয়ার আগে অবশ্যই বহির্গমন ছাড়পত্র নিতে হবে। অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হলে অবশ্যই এমপ্লয়মেন্ট ভিসা থাকতে হবে। সঠিক ভিসা ছাড়া বিদেশে গেলে প্রতারিত হতে হবে। যে চুক্তিতে বিদেশে যাচ্ছেন, সেই চুক্তি সঠিক কি না, সেটি বিএমইটি কিংবা বায়রায় গিয়ে জানতে হবে। যে পদে যাচ্ছেন, সে পদের বেতন, ভাতা, চিকিৎসা, আহার, বাসস্থান, কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম—এগুলোর ব্যাপারে কী বলা আছে, তা জানতে হবে। এ বিষয়গুলো মানলে প্রতারণা অনেক কমে আসবে।মাহমুদা আক্তার বলেন, চাকরির শর্ত না জেনে কোনোভাবেই বিদেশে যাওয়া যাবে না। বিদেশে গৃহস্থালি কাজে যাওয়ার আগে অবশ্যই প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বর্তমানে মিরপুরের দারুসসালামে অবস্থিত মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে এ প্রশিক্ষণ হয়। যাওয়ার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। সর্বশেষ বিএমইটি অফিসে গিয়ে বিফ্রিং নিতে হবে।বিদেশে সম্ভাব্য ঝুঁকিবিদেশে যাওয়ার পর প্রতারক চক্র নানা প্ররোচনার মাধ্যমে কাগজপত্র নিয়ে যেতে পারে। কাজেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাবধানে রাখতে হবে। এ ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানে বেশি বেতনে কাজের লোভ দেখিয়ে দালালেরা নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেটি করা যাবে না। কারণ শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানির আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই যেখানে কাজ করবেন সেখানকার বাজার, দোকানপাট, স্থানীয় চিকিৎসাকেন্দ্র, যাতায়াতব্যবস্থা এগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সাহস নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আর যে দেশে যাচ্ছেন, সে দেশের প্রাথমিক ভাষাজ্ঞান থাকা উচিত। যেকোনো বিপদে পড়লে সবাইকে দূতাবাসে যোগাযোগ করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.