ফুটপাত দখল, চাঁদাবাজি, মাদক, মশা
শরিফুল হাসান
সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হয়েছে দুই বছর। অনেক স্থানে উন্নয়ন হয়েছে। আবার কোথাও কিছুই হয়নি। এলাকার সমস্যা, সম্ভাবনা, অভাব-অভিযোগ, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে ওয়ার্ডের চালচিত্র

শাহবাগের ফুটপাতজুড়ে ফুলের দোকান। আজিজ সুপার মার্কেটের পশ্চিমের ফুটপাতে রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ। পরীবাগের ফুটপাতে টাইলসের দোকান। সাধারণ মানুষের হাঁটার জায়গা নেই বললেই চলে। কেবল ফুটপাতই নয়, রাস্তায়ও আছে ভ্রাম্যমাণ নানা দোকান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বেশির ভাগ সড়কের এই হাল। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, এখানকার ফুটপাতজুড়ে চলে নিয়মিত চাঁদাবাজি। যাঁরা এই কাজ করেন, তাঁরা নিজেদের ওয়ার্ড কমিশনারের লোক বলে পরিচয় দেন। এর বাইরে আছেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা।
চাঁদাবাজির বাইরে মাদক ও মশার উপদ্রব এখানকার আরেকটি সমস্যা। এ ছাড়া পলাশী থেকে নীলক্ষেত ও ফুলার রোডে মাঝেমধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন।
২১ নম্বর ওয়ার্ডটি আগে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড নামে পরিচিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এখানে রয়েছে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আবাসিক হল। আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় জাদুঘর, জাদুঘর অফিসার্স কোয়ার্টার, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। পরীবাগ, হাতিরপুল এলাকাও পড়েছে এই ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের ভোটার মাত্র ২৭ হাজার।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, ওয়ার্ডে কোনো কমিউনিটি সেন্টার নেই। পরীবাগের সড়কে সব সময় আবর্জনা থাকে। ওয়ার্ডের একমাত্র পার্ক পান্থকুঞ্জে ভবঘুরেদের আনাগোনা বেশি। এই পার্কের সামনে সব সময় বর্জ্য পড়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম, এসএম হলের শামছুল আরেফিনসহ হলগুলোর ছাত্রদের সাধারণ অভিযোগ, মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ তাঁরা। তাঁদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সব কাজ তো বিশ্ববিদ্যালয়ই করে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর যদি মশাও না মারতে পারেন, তাহলে তাঁর কাজটা কী এখানে?
ওয়ার্ডটির প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ। গতকাল বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ততম এই এলাকায় থানা ঘেঁষে ফুটপাতে বসানো হয়েছে ফুলের মার্কেট। শিশুপার্ক পর্যন্ত ফুটপাতের এই হাল। শুধু ফুটপাতই নয়, রাস্তারও একাংশ ফুল ব্যবসায়ীদের দখলে। নিয়মিত সেখানে গাড়ি থামছে। ফলে সারা দিন লেগে থাকে যানজট।
শিশুপার্কের পরপর একটি পাবলিক টয়লেট আছে। এটি ২০ নম্বর ওয়ার্ডে পড়লেও মূলত ২১ নম্বর ওয়ার্ডের লোকজন ব্যবহার করে। এই টয়লেটের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, সেটি ফুল ও বিভিন্ন সরঞ্জামে ঠাসা। সাধারণ মানুষ পাঁচ টাকা দিয়ে টয়লেটে গেলেও কোনো রকমে ব্যবহার করতে পারেন। উৎকট দুর্গন্ধে সেখানে টেকা দায়। টয়লেটের সামনে টাকা তোলার দায়িত্বে থাকা হানিফ সরদার বলেন, ফুলের দোকানদারেরা এগুলো রেখে যায়। পরিবেশ এত নোংরা কেন জানতে চাইলে তিনি আর কিছু বলেননি।
এই টয়লেট থেকে একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়ে একটি ভবন। সেখানে আওয়ামী লীগের একটি বড় ফেস্টুন লাগানো। তাতে এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এম এ হামিদ খানের নামের পাশাপাশি শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির নাম দিয়ে নিচে লেখা প্রচারে মামুন খন্দকার মিন্টু। স্থানীয় ফুল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভবনটি ২১ নম্বর ওয়ার্ডে পড়লেও শাহবাগের চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা—সবকিছু এই ভবন ঘিরে চলে। স্থানীয় ফুল ব্যবসায়ীদের দাবি, তাঁরা এখানকার সরকারি দলের লোকজনকে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করেন।
ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করার বিষয়ে শাহবাগ ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের এখানে ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়।’
ফুলের দোকান ছাড়াও শাহবাগের ফুটপাত ও রাস্তার আশপাশে আছে ৩৫ থেকে ৪০টি দোকান। এসব দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।
শাহবাগ মোড় থেকে আজিজ সুপার মার্কেটের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবনের সামনেও আছে ভ্রাম্যমাণ অনেকগুলো দোকান। আজিজ সুপার মার্কেট পেরিয়ে ডান পাশের ফুটপাত ধরে পরীবাগের দিকে এগোতে গেলে পুরো ফুটপাতই রিকশা-ভ্যানের দখলে। আবর্জনায় ভরা এখানকার রাস্তা। ফুটপাতে লোকজন অস্থায়ীভাবে বাস করছে। দিনে রাতে তারা এখানেই ঘুমায়।
পরীবাগের এই এলাকাসহ শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে কেন্দ্র করে নিয়মিত মাদক ব্যবসা চলে বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং এই এলাকার বাসিন্দারা।
পরীবাগ থেকে কাঁঠালবাগান ঢালের দিকে যেতে ফুটপাতে আছে আবার টাইলসের দোকান। সড়কের বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলোভাবে ট্রাক, পিকআপ ও রিকশা-ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ফলে সাধারণ লোকজনের হাঁটা দায়।
পরীবাগ এলাকার বাসিন্দা একটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানালেন, ‘হাতিরপুলের এই রাস্তা দিয়ে সাধারণ মানুষের হাঁটাচলা করা কঠিন। কারণ, ফুটপাত দখলে থাকে। আর এই ওয়ার্ডের পরীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় সব সময় আবর্জনা জমে থাকে। বিশেষ করে পরীবাগে, পান্থকুঞ্জের সামনে ময়লার স্তূপ। শাহবাগ থানা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতেই আবার ময়লার স্তূপ। স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে এসব সমস্যার সমাধান চাই।’