সম্প্রীতির ইফতার
শরিফুল হাসান

হাজারো মানুষ বসে আছেন সারিবদ্ধভাবে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-বৃদ্ধ নানা বয়সের মানুষ। কারও পোশাক-আশাকে আভিজাত্যের ছাপ, কারও দারিদ্র্যের। তবে কারও মধ্যে কোনো জড়তা নেই। সবাই একই রকম ইফতার নিয়ে বসে আছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ইফতাির বলতে ছোলা, পেঁয়াজু, মুড়ি মাখা আর এক গ্লাস শরবত।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে চোখে পড়ল এমনই পরিবেশ। মাগরিবের আজানের আগমুহূর্তে সবাই একসঙ্গে মোনাজাত করলেন। এরপর ইফতার শেষে সবাই নামাজে দাঁড়ালেন।
ইফতারের আগে কথা হলো রাজধানীর খিলক্ষেতের ব্যবসায়ী আবুল বাশারের সঙ্গে। বায়তুল মোকাররমে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনেছি অনেক মানুষ এখানে একসঙ্গে ইফতার করে। আমি এবারই প্রথম এলাম। এত মানুষ এত সুন্দরভাবে ইফতার—মনটা ভরে যাচ্ছে।’
ফার্মগেটের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত আছেন শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এবারের রোজায় আমি আজ দ্বিতীয় দিন বায়তুল মোকাররমে ইফতার করলাম। এখানে না এলে ইফতারের অনন্য পরিবেশ সম্পর্কে কেউ জানতেই পারবেন না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহসীন হলের ছাত্র আলামিন প্রতিদিন হলে ইফতার করেন। আলামিন বললেন, ‘আজ মনে হলো বায়তুল মোকাররমে ইফতার করব। তাই চলে এসেছি। এসে মনে হচ্ছে খুব ভালো কাজ করেছি।’
লক্ষ্মীপুরের চাটখিলের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি জীবনে প্রথমবার এলাম। এই অনুভূতি প্রকাশ করার নয়।’
মসজিদের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে এবং বায়তুল মোকাররম মসজিদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দক্ষিণ পাশে যেসব রোজাদার বসেছেন, তাঁদের ইফতারের ব্যবস্থা করেছেন বায়তুল মোকাররমের ব্যবসায়ী ও তাবলিগ জামাতের লোকজন। সেখানে জিম্মাদার হিসেবে ছিলেন আবুল কালাম। জানতে চাইলে আবুল কালাম বলেন, ‘আমরা ৫০ জন ব্যবসায়ী যে যা পারি টাকা তুলে এই আয়োজন করছি। ইফতার শেষে আমরাই মসজিদ পরিচ্ছন্ন করি। চার বছর আগে এই ইফতারের আয়োজন শুরু হয়েছিল। উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ প্রতিদিন এখানে ইফতার করতে আসেন।’
ব্যবসায়ীরা জানালেন, মসজিদের পশ্চিম পাশে ইফতারের আয়োজনের কাজটি করছেন হাবিবুর রহমান। তিনি বায়তুল মোকাররমে প্রথম ইফতারের উদ্যোক্তাদের একজন। কথা বলতে গেলে ষাটোর্ধ্ব হাবিবুর বললেন, ১৭ বছর তিনি সৌদি আরবে ছিলেন। ১৯৯৭ সালে দেশে ফিরে এখানে রোজাদারদের ইফতার করাতে শুরু করেন। যে যা পারেন সাহায্য করেন।
মসজিদের উত্তর পাশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ইফতার চলে প্রথম রোজা থেকে। ২০০৯ সাল থেকে তারা এ কাজটি করে আসছে বলে জানালেন বায়তুল মোকাররমের কর্মী আতিকুর রহমান। তিনি জানান, প্রতিদিন এখানে হামদ-নাত পড়া হয়। ইফতারের আগে ধর্মীয় বয়ান করেন দেশের বিশিষ্ট আলেমরা।
ইফতারের সময় কথা হলো বয়ান করতে আসা কক্সবাজারের মসজিদ আল খিজিরের খতিব মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম সিদ্দিকীর সঙ্গে। এখানকার ইফতারের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইসলামে ধনী-গরিবের মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হয়নি। ধনী-গরিব একসঙ্গে বসে ইফতার আল্লাহর অনেক পছন্দ। বায়তুল মোকাররমে সেটিই হচ্ছে। সমাজের সর্বত্র সব কাজে যদি এই সাম্য ছড়িয়ে পড়ে, তবেই সত্যিকারের শান্তি আসবে।’