শরিফুল হাসান
বৃষ্টি এখন আর উপভোগ করতে পারে না এই শহরের বাসিন্দারা। গল্প-কাব্যের বৃষ্টির স্বাদ বাস্তবে পায় না তারা। বরং বৃষ্টি এখন বিভীষিকা। গতকাল সোমবারের বৃষ্টি তো বিভীষিকায়ই রূপ নিল শেষ পর্যন্ত। কারণ এই শহরে এখন সংস্কারের জন্য পয়োনালাগুলো হাঁ করে খোলা। বৃষ্টির পানির সঙ্গে সেই পয়োবর্জ্য মিলে যে পানি শহরময় ছড়িয়েছে তা মাড়িয়েই সারা দিন চলতে হয়েছে মানুষকে।
খোঁড়া রাস্তার দুধারে জমানো বালু-ময়লা বৃষ্টিতে থকথক কাদায় রূপ নিয়েছে। তা মাড়িয়েই সকালে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, চাকরিজীবীদের অফিসে, শ্রমজীবীদের কাজে ছুটতে হয়েছে। ভাঙা রাস্তায় হঠাৎ উল্টে পড়ছে কোনো রিকশা। আরোহীরা কাদাপানিতে মাখামাখি। মার্কেট-দোকানগুলোর সামনে পানি সেচতে হয়েছে কর্মচারীদের।
দুর্বিনীত গণপরিবহনগুলো কাদাপানি ছিটিয়ে চলে গেছে পথচারীদের পাশ দিয়ে। পরিবহনের অপেক্ষায় অনেকে ভিজেছে রাস্তায়। রিকশা, সিএনজিতে গুনতে হয়েছে বাড়তি ভাড়া। ঠকঠক করে কাঁপতে দেখা গেছে কাকভেজা রিকশাচালককে। পানিতে বন্ধ হয়ে গেছে সিএনজির ইঞ্জিন। হদিস ছিল না নগরের হাতে গোনা ট্যাক্সিসেবার। সচ্ছল যাত্রীদের কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে নগরে নতুন উবার সার্ভিস। তবে তাও শেষ পর্যন্ত থেমে গেছে যানজটে। যানজটে বসে ক্ষুব্ধ লোকজন গালি দিয়েছে ফ্লাইওভারকে, কেউ নগর ব্যবস্থাপনাকে, কেউ সরকারকে।
গতকাল মালিবাগ-মৌচাক মোড়ের দৃশ্য ছিল অবর্ণনীয়। একদিকে ফ্লাইওভারের বিলম্বিত নির্মাণযজ্ঞ, খুলে রাখা নালার পানি, রাস্তার স্থানে স্থানে তৈরি গর্ত ওই এলাকা দিয়ে চলাচলকারীদের কেবল ভুগিয়েছে। দুপুরে বৃষ্টি থামলেও দুর্ভোগ যে শেষ হবে তা জানাই ছিল এ এলাকার লোকজনের। মালিবাগ মোড়ে পানির নিচে লুকিয়ে থাকা এক গর্তে যাত্রী নিয়ে উল্টে পড়েছে একাধিক রিকশা।
কেবল মৌচাক-মালিবাগই নয়, গতকাল বৃষ্টি ভুগিয়েছে সবাইকে, পুরো রাজধানীবাসীকেই। ফুটপাতের ব্যবসায়ী, দিনমজুরসহ নিম্ন আয়ের মানুষ দুর্ভোগের পাশাপাশি রোজগারও হারিয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নারী ও শিশুদের।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পারভেজ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মগবাজার ডাক্তারের গলিতে থাকি। ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে রাস্তাঘাটের নির্যাতন তো আছেই। বৃষ্টিতে সেই যন্ত্রণা এতটাই বাড়ে যে মনে হয় নরক নেমে এসেছে মালিবাগ-মৌচাকে। কবে এই যন্ত্রণা শেষ হবে কেউ বলতে পারে না।’
মৌচাক মার্কেটের সামনের ফলবিক্রেতা জাকির হোসেন জানান, বৃষ্টি আর পানি তাঁর ৭০ হাজার টাকার ফল নষ্ট করে দিয়েছে। মৌচাক মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ দেলওয়ার হোসেন বললেন, এখানকার রাস্তায় ছোট-বড় অনেক গর্ত। বৃষ্টির কারণে সেসব গর্ত দেখা যায় না। ফলে রিকশা উল্টে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সোনম সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি মানেই বেইলি রোড-সিদ্ধেশ্বরী-মৌচাক-মালিবাগ-শান্তিনগর-কাকরাইলে দুর্ভোগ। একদিকে ফ্লাইওভার নির্মাণের অত্যাচার, আরেক দিকে এলোমেলোভাবে পয়োনিষ্কাশন লাইনের কাজ চলছে। রাস্তার যেখানে-সেখানে গর্ত তো আছেই। বছরের পর বছর ধরে এই দুর্ভোগ চলছে। বৃষ্টির দিনে এর মধ্যে চলাফেরা করা ভয়াবহ কঠিন।
শান্তিনগরের মোড়ে বাচ্চাকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরা গৃহবধু জেসমিন রেজিয়া বলেন, বৃষ্টির চেয়ে বড় দুর্ভোগ নোংরা পানি। বাচ্চাদের গায়ে এই পানি লেগে রোগবালাই হয়।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রায়হানুল আজিমের সঙ্গে দুপুরে কথা হয় মতিঝিলে। তিনি বলেন, বাসা মিরপুরে। সকালে রিকশায় করে ১০ নম্বরে এসেছেন বৃষ্টিতে ভিজে। সেখান থেকে অফিসে। বৃষ্টির দিনগুলোতে এই শহরে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন খুবই কঠিন।
পোস্তগোলা থেকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠার আগে চোখে পড়ল দোলাইরপাড় থেকে দনিয়া যাওয়ার রাস্তা পানিতে সয়লাব। স্থানীয় বাসিন্দা মাহমুদ হোসেইন জানালেন, দোলাইরপাড়ের একে স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে এক দিন বৃষ্টি হলে পাঁচ দিন পানি জমে থাকে। আর ডেমরায় বেশির ভাগ এলাকায় বৃষ্টি হলেই রাস্তার ওপর হাঁটুপানি থাকে। ফলে এসব এলাকায় রিকশা চালাতে খুব কষ্ট হয়।
বাড্ডার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানালেন, বাড্ডা-গুলশান লিংক রোডে দক্ষিণ দিকের ফুটপাতে পয়োনর্দমা স্থাপনের কাজ চলছে। এই এলাকায় গত তিন দিনে খানাখন্দে পানি জমে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বৃষ্টিতে পুরান ঢাকার বকশীবাজার রোড, হোসেনি দালান রোড, নাজিমুদ্দিন রোড, জেলখানা রোড, বেগমবাজার, চকবাজার, উর্দু রোড থেকে শুরু করে ডেমরা, মানিকদি, জুরাইন, দক্ষিণখান, বাড্ডা, মিরপুর, কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুরসহ অনেক এলাকায় রাস্তাঘাটে পানি জমে যায়।
অনেক এলাকায় সড়কের পাশে সিটি করপোরেশনের পয়োনালা নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজ চলায় দুর্ভোগ ছিল আরও বেশি। অনেক এলাকার পানিতে ময়লা ভেসেছে। কেবল যে সকালের বৃষ্টির কারণেই মানুষের দুর্ভোগ হয়েছে, তা নয়। বৃষ্টির কারণে গতকাল সারা দিনই শহরে ছিল যানজট। ফলে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতে মানুষকে আরেক দফা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।