কয়েক বছর ধরে একই বেতন

Spread the love

জর্ডানে বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশি শ্রমিকেরা রাস্তায়

শরিফুল হাসান

বেতন বাড়ানোর দাবিতে জর্ডানে কর্মরত হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক রাস্তায় নেমেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত দুই হাজার বাংলাদেশি। কয়েক দিন ধরে এই শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালিয়েছে, যাতে ২৫ থেকে ৩০ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। পটুয়াখালীর জলিলুর রহমান, পাবনার আলতাফ হোসেন, কুমিল্লার আফসারুল ইসলাম, বরিশালের আবদুল হাইসহ বেশ কয়েকজন জর্ডান থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে তাঁদের দুরবস্থার কথা জানান। শ্রমিকেরা তাঁদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও দূতাবাসকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। শ্রমিকদের অভিযোগ, দূতাবাস এ ব্যাপারে কিছু করছে না।বিক্ষোভকারী অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। তবে জর্ডানের বাংলাদেশ দূতাবাস এবং ঢাকায় বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। জর্ডান থেকে জলিলুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। রাজধানী আম্মানের সাহাব শিল্প এলাকার আলতাজোমোর স্টারলিং অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের শ্রমিকেরা প্রথম বেতন ১১০ জর্ডানি দিনার (১১ হাজার টাকা) থেকে ১৫০ দিনার (১৫ হাজার টাকা) করার দাবিতে দুই সপ্তাহ আগে আন্দোলন শুরু করেন। শ্রীলঙ্কার শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করলেও এখন বাংলাদেশিরা এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই কারখানায় ৪০০ বাংলাদেশি কাজ করেন। প্রবাসী শ্রমিকেরা জানান, স্টারলিং কারখানায় শুরু হওয়া এই আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়েছে আরও আটটি প্রতিষ্ঠানে। এসব কারখানায় বাংলাদেশের হাজার দুয়েকসহ শ্রীলঙ্কা, ভারত ও ফিলিপাইনের মোট আট থেকে দশ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জর্ডানের আন্দোলন মানে স্লোগানসহকারে বিক্ষোভ প্রদর্শন নয়। রাস্তা দিয়ে চুপচাপ হেঁটে যেতে হয়। কিন্তু এর পরও স্টারলিং কারখানার আন্দোলন দমাতে পুলিশ মঙ্গলবার কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করেছে। এতে অন্তত ১৬ জন বাংলাদেশিসহ ৩০ জন শ্রমিক আহত হন। বিক্ষোভ করায় ৩০ জন বাংলাদেশিসহ ৪২ জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলন দমাতে কারখানার মালিকেরা কর্মীদের খাবার ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। জলিল ও আলতাফসহ সব প্রবাসী শ্রমিকের অভিযোগ, নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে বেতন বাড়ানোর কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। এর ফলে তাঁদের বিদেশ যেতে খরচ হওয়া দুই-আড়াই লাখ টাকা না ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই বেতন বাড়ানো না হলে তাঁরা টিকতে পারবেন না। কিন্তু কোম্পানির এ অনিয়মের ব্যাপারে বাংলাদেশ দূতাবাসে বারবার বলার পরও এ ব্যাপারে কোনো সহায়তা করা হচ্ছে না। অথচ শ্রীলঙ্কাসহ সব দেশের শ্রমিকদের দেখভাল করছেন তাঁদের দূতাবাসের লোকজন। প্রবাসী শ্রমিকেরা জানান, শ্রীলঙ্কার শ্রমিকেরা শুরু করলেও এখন সব দেশের অভিবাসী শ্রমিকেরাই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। চলমান শ্রমিক বিক্ষোভ এবং বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে জর্ডানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার তৌফিক ইসলাম শাতিল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিকেরা বেতন বাড়ানোর এই দাবি মানতে রাজি নন। বেতন বাড়াতে হলে সব কারখানাতেই তা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে ঘোষণা দিতে হবে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।’ সমস্যা সমাধানে দূতাবাস কী করছে, জানতে চাইলে তৌফিক ইসলাম বলেন, ‘দূতাবাসের বিরুদ্ধে শ্রমিকেরা যে অসহযোগিতার অভিযোগ করেছেন, সেটা মোটেও ঠিক নয়। আমরা ওই কারখানাগুলোতে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে এসেছি। আমাদের রাষ্ট্র্রদূত জর্ডানের শ্রমসচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন।’কনস্যুলার তৌফিক ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা কোম্পানির মালিকদের বলেছিলাম, তোমরা আগে বেতন বাড়িয়ে দাও। পরে সরকার ঘোষণা দেবে। কিন্তু তাঁরা রাজি হচ্ছেন না। এ মুহূর্তে সাতটি কোম্পানিতে আন্দোলন চলছে। সেখানে হাজারখানেক বাংলাদেশি আছেন।’তৌফিক ইসলাম বলেন, তাঁরা জর্ডান সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলার পর সরকার কারখানা-শ্রমিকদের খাবার ও পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ দিয়েছে। সরকার বিষয়টিকে অমানবিক আখ্যায়িত করে এ ব্যাপারে মালিকদের চাপ দিচ্ছে। যোগাযোগ করা হলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণসচিব জাফর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূতাবাসের মাধ্যমে আমরা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। এই শ্রমিকেরা চার-পাঁচ বছর ধরে একই বেতনে কাজ করছেন। কাজেই তাঁদের বেতন বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক। এক দফায় না পারলেও ধাপে ধাপে বেতন বাড়ানো যেতে পারে। দূতাবাস জর্ডান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে আমরা প্রবাসী শ্রমিকদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাব অনুযায়ী, জর্ডানে প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত। তাঁদের বেশির ভাগই কাজ করেন পোশাক কারখানায়। এদিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় বার্তা সংস্থা লঙ্কাপুভাত জানিয়েছে, জর্ডানের শ্রম মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য শ্রীলঙ্কার দূতাবাসের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ বলেছে, আন্দোলনে অন্য দেশের শ্রমিকেরাও জড়িয়ে গেছেন বলে শ্রীলঙ্কার একার পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কার অনলাইন পত্রিকা ‘আদারেকা’র এক খবরে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার ব্যুরো অব ফরেন এমপ্লয়মেন্ট (এসএলবিএফই) সমস্যা সমাধানের জন্য জর্ডানের শ্রম মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। এসএলবিএফইর চেয়ারম্যান কিংসলে রনোকা বলেছেন, পরিস্থিতির দিকে শ্রীলঙ্কা বিশেষ মনোযোগ রাখছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.