শরিফুল হাসান
দেশের শীর্ষ স্থানীয় উদ্যোক্তা লতিফুর রহমানকে স্মরণ করছি। আমি সবসময় বলি, বাংলাদেশে যদি লতিফুর রহমানের মতো আরও কয়েকজন ভালো বিনিয়োগকারী থাকতেন তাহলে গোটা গণমাধ্যমের চেহারা বদলে যেতো। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের মালিক হয়েও কোনদিন তিনি এতোটুকু এই ক্ষমতার ব্যবহার করেননি।
বরং সবসময় ছিলেন ভীষণ বিনয়ী।প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের মালিক, বাংলাদেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান দুই বছর আগে এই ১ জুলাই মারা যান। খবরটা শুনে সেদিন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। নিয়তির কী পরিহাস লতিফুর রহমান এমন দিনে ঘুমের মধ্যে মারা গেলেন, যেদিন তার প্রিয় নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেনেরও মৃত্যুবার্ষিকী।
ফারাজ ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজান রেস্তোরায় জঙ্গি হামলার নিহত হন। সেদিন রাতে আমি গুলশানে ছিলাম। সিমিন আপাসহ এই পরিবারের অনেককে কাছ থেকে দেখেছি। ফারাজকে ভীষণ ভালোবাসতেন লতিফুর রহমান। জানি না তাঁর কথা স্মরণ করতে করতেই তিনি চলে গেলেন কী না।লতিফুর রহমান শুধু প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার নয়, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড,আন্তর্জাতিক ফুড চেইন পিৎজা হাট ও কেএফসি, পেপসি এবং ফিলিপসের বাংলাদেশে ফ্রাঞ্চাইজির মালিক ছিলেন। তিনি ২০১২ সালে মর্যদাপূর্ণ বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন।
এতো বড় একজন মানুষ কিন্তু ভীষণ বিনয়ী ছিলেন। মানুষকে দারুণ শ্রদ্ধা করতেন। আমি ২০০৫ থেকে ২০১৭ টানা ১২ বছর প্রথম আলোয় কাজ করেছি। কোনদিন দেখিনি, শুনিনি তিনি প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের মালিক হিসেবে কখনো তিনি সাংবাদিক বা সংবাদের ওপর বিন্দুমাত্র প্রভাব খাটাচ্ছেন। সত্যি বলতে কী, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকির দিন ছাড়া তিনি কখনো প্রথম আলোতেই আসতেন না। ফলে সাধারণ মানুষ যেমন তাকে চিনতো না, এমনকি এই পত্রিকার সাংবাদিকরাও তাকে চিনতো না। আমি নিজে এমন কয়েকটি ঘটনার স্বাক্ষী। কোন এক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লতিফুর রহমান প্রথম আলোতে ঢুকবেন।
রিসিপশনের সোনিয়া আপা তাকে আটকে দিয়েছে। কারণ সোনিয়া আপা তাকে চেনেন না। আমি নিজে তখন তাকে এগিয়ে আনি। তিনি এতোটুকু কিছু মনে করেননি। বরং বলেছিলেন, মেয়েটা তার কাজটা ঠিকমতো করেছে।আরেকটা ঘটনা বলি। লতিফুর রহমানকে প্রথম আলোর এক কর্মী না চিনে লিফট থেকে নেমে যেতে বলেছিলেন। তিনি চুপ করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমি এমন অনেক ঘটনা বলতে পারবো। প্রথম আলো শুরুতে সবাইকে ওয়েজবোর্ড দিতে চাইছিল না বিশেষ করে প্রুফ রিডারদের। তিনি তখন প্রথম আলোকে বলেন, অল্প কিছু টাকার জন্য কিছু লোককে কেন বঞ্চিত করবে?
একইভাবে তিনি সাংবাদিকদের গাড়িসহ নানা সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদা দেয়ার কথা সবসময় বলতেন। সাংবাদিকদের একজন মানুষ কতোটা সম্মান করতে পারেন তার প্রমাণ ছিলেন তিনি। আমি বলবো অনেক সম্পাদক সাংবাদিকের চেয়েও তিনি সাংবাদিকদের বেশি মর্যাদা দিতেন। ২০০৮ সালে তাঁর ও সম্পাদক মতিউর রহমানের হাত থেকে আমার সেরা সাংবাদিকের পুরস্কার নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।আমার পর্যবেক্ষণ হলো, প্রথম আলো আর ডেইলি স্টারের আজকে এই জায়গায় আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান লতিফুর রহমানের। সাংবাদিকদের তিনি সত্যিকারের শ্রদ্ধা করতেন।
গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব চাইতেন। সাংবাদিকদের বেতন সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদা সবসময় বাড়ানোর কথা বলতেন। সবসময় বলতেন, গণমাধ্যমের নিজের আয়ে চলা উচিত। তাহলে মালিক পক্ষ কখনো সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। মাঝে মধ্যেই মনে হয় লতিফুর রহসানের মতো মানুষের বিনিয়োগ গণমাধ্যমকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে। ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, সাপ্তাহিক ২০০০, এবিসি রেডিও সবকিছুর প্রমাণ তিনি। এই ক্রান্তিকালে তার চলে যাওয়া ভীষণ কষ্টের। সত্যিকারের ব্যাবসায়ী মানুষ তিনি।
লতিফুর রহমান নেই কিন্তু তাঁর জীবনের আদর্শগুলো আমরা চর্চা করতে পারি। একজন লতিফুর রহমানের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি বহু কিছু। ব্যবসায়ীরা শিখতে পারেন কি করে আজীবন সৎভাবে ব্যবসা করতে হয়। শিখতে পারেন একজন উদ্যাক্তা কিভাবে কর্মী বান্ধব হতে পারেন। ক্ষমতাশালীরা শিখতে পারেন ক্ষমতা বা প্রভাব থাকলেও সেগুলো ব্যবহার না করে কি করে বিনয়ী থাকা যায়। মিডিয়া মালিকরা শিখতে পারেন কি করে নিরপেক্ষ মিডিয়া গড়ে তোলা সম্ভব। শিখতে পারেন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিডিয়ার মালিক হওয়ার পরেও কি করে সেখান থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হয়।
শিখতে পারেন কি করে সাংবাদিকদের মর্যাদা দিতে হয়।কথায় কথায় যারা বিদেশে সম্পদ করেন তারা শিখতে পারেন নিজে এবং নিজের পরিবারের সবাইকে নিয়ে কি করে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে থাকা যায়। তিনি সবসময় বলতেন আমার একটাই পাসপোর্ট এবং সেটা বাংলাদেশের। আমি বাংলাদেশেই থাকতে চাই। আসলেও তাই। তিনি শেষদিকে গ্রামে থাকতেন এবং বাংলাদেশের গ্রামের মাটিতেই মারা গেছেন।
লতিফুর রহমানকে দেখে হতাশ ও কষ্ট পাওয়া মানুষরা শিখতে পারেন নানান শোকে ভেঙে না পড়ে, কি করে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হয়। বুকের মধ্যে কষ্ট চাপা দিয়ে কী করে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায়।লিখলে আরও বহু কথা লিখা যায়।
বাংলাদেশের এত বড় একজন শিল্পপতি অথচ সবসময় নিজে সবার আগে তাঁর কর্মীদের সালাম দিতেন। এর নাম বিনয়! আফসোস আমরা লতিফুর রহমানদের কাছ থেকে শিখি না। এমনকি তার গড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররাও না।
আর সে কারণেই বাংলাদেশে আবুল বাবুল শ্যামলা শাতুলদের মতো হাজার হাজার কোটিপতি থাকে, কিন্তু লতিফুর রহমানের মত মানুষ থাকেন হাতে গোনা। অথচ সততা, মানবিকতা, দেশপ্রেম, বিনয়, মানুষের প্রতি মর্যাদাবোধসহ বহুকিছুর পাঠ্য হতে পারেন লতিফুর রহমান। আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা। আল্লাহ তাকে বেহেশতে নিক। ভালো থাকুন প্রিয় লতিফুর রহমান স্যার।