আজ দুই পক্ষে চুক্তি হচ্ছে

Spread the love

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো নিয়ে আবারও অস্বচ্ছতা

শরিফুল হাসান

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো নিয়ে মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। বায়রার অভিযোগ, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি না করে গুটি কয়েক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর হাতে পুরো ব্যবসা তুলে দেওয়া হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার সব সদস্যকে চিঠি দিয়ে ‘সিন্ডিকেট তৈরির তৎপরতা’ রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বায়রা। একই সঙ্গে সংগঠনটি প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী এবং এই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতিকে চিঠি দিয়েছে।
১৫ লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় যাবেন—চার বছর ধরে বারবার এমন কথা বলা হচ্ছে। মালয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় এখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। কাজেই ১৫ লাখ শ্রমিক নেওয়া হবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
এ অবস্থায় গতকাল বুধবার রাতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী রিচার্ড রায়ত জায়েমের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসার কথা। আজ বৃহস্পতিবার সকালে মন্ত্রণালয়ে দুই দেশের মধ্যে জি টু জি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) প্লাস সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হবে। ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় জি টু জি প্লাস নামের ওই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুমোদন দেওয়া হয়।
নতুন এই সমঝোতায় বিদেশগামী কর্মীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের হাতে থাকছে। ফলে একেকজন কর্মীর মালয়েশিয়া যেতে ৩৪ থেকে ৩৭ হাজার টাকা খরচ হবে বলা হলেও বাস্তবে অতীতের মতোই ঘটনা ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এর আগে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য যে সাড়ে ১৪ লাখ লোক নিবন্ধন করেছিলেন, তাঁদের পাশাপাশি নতুন কর্মীরাও নিবন্ধন করতে পারবেন। এ ছাড়া কর্মী চূড়ান্ত হওয়ার পর পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পন্ন হবে। মালয়েশিয়ায় একটি ওয়ান স্টপ সেন্টার থাকবে।
মালয়েশিয়ায় কয়েক লাখ বাংলাদেশিসহ পাঁচ থেকে ছয় লাখ অবৈধ শ্রমিক রয়েছেন। সে দেশের সরকার এককজন শ্রমিকের কাছ থেকে ১ হাজার ২০০ রিঙ্গিত (প্রায় ২২ হাজার টাকা) নিয়ে তাঁদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিতে চায়।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং এই খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জি টু জি প্লাস অনুযায়ী মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা ওয়ান স্টপে প্রথমে তাঁদের চাহিদাপত্র দেবেন। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র, মানবসম্পদ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সেটি যাচাই-বাছাই করবে। এরপর নিয়োগকর্তারা লেভি (কর) দেবেন। যে কটি চাহিদাপত্রের অনুমতি পাবেন, নিয়োগকর্তারা সেই কটির জন্য ঢাকায় জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে চাহিদাপত্র পাঠাবেন। এরপর সরকারি ডেটাবেইস থেকে কর্মীদের নামের তালিকা দেওয়া হবে। সেই তালিকা বিশেষ করে আঙুলের ছাপ যাচাই-বাছাই করবে মালয়েশিয়া। তালিকার অনুমোদন পাওয়া গেলে লোক পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।
আগে জি টু জি প্রক্রিয়ায় সরকারিভাবে টাকা নেওয়া হলেও এবার কর্মীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার দায়িত্ব পাচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। ফলে অতীতের মতোই কর্মীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা নেওয়ার সুযোগ থাকবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর।
সরকার কেন এই প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ করছে না—জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৭-০৮ সালে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকারি খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৪ হাজার টাকা। কিন্তু সেবার দুই থেকে তিন লাখ টাকাও নিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ওই সমস্যা এড়াতে এবার দুটি প্রস্তাব ছিল। একটি হলো মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা নিজেই খরচ বহন করবেন। এরপর শ্রমিকের বেতন থেকে সেটি কেটে নেওয়া হবে। কিন্তু মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা সেটি মানেননি। দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মীর কাছ থেকে সরাসরি কোনো টাকা নেবে না; বরং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি ব্যাংক হিসাব থাকবে। সেখানেই টাকা লেনদেন হবে। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সেই প্রস্তাব মানেনি। ফলে কর্মীদের প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থেকেই গেল।
মন্ত্রণালয় সূত্র ও বায়রা জানায়, মালয়েশিয়া কর্মী নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই দুটি পক্ষ তৎপর হয়ে ওঠে। একটির নেতৃত্বে আছেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মালয়েশীয় নাগরিক ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিন বিন আবদুন নূর। তাঁর সঙ্গে আছে ১০ থেকে ১২টি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। আর মালয়েশীয় নাগরিক ও আরেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আবু হানিফের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বায়রা। তবে শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ আমিন ও তাঁর প্রতিষ্ঠান সিনারফ্ল্যাক্সই অনলাইন প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছে বলে জানা গেছে।
বায়রার সভাপতি আবুল বাসার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই দেখছি, একটি চক্র মালয়েশিয়ার কাজের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। আমরা বারবার এর বিরোধিতা করেছিলাম। মন্ত্রী-সচিব সবাই আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, এমনটি হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনারফ্ল্যাক্সই কাজ পেতে যাচ্ছে। এর ফলে ১০-১২ জন লোক ব্যবসা করবে। এতে বিদেশগামী ব্যক্তিরা প্রতারিত হবেন বলে আমাদের আমঙ্কা। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে পুরো বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করছি।’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমঝোতা স্মারকের কোথাও বায়রা শব্দটি ছিল না। সেখানে বিআরএ (বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্ট) শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির একটি তালিকা করবে। সেই তালিকা পাঠানো হবে মালয়েশিয়ায়। এই তালিকায় যাঁরা থাকবেন, তাঁরাই শুধু লোক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন।
জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কাজী আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, সেগুলোর নামই তালিকায় স্থান পাবে।’
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন কারাম এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হারুন আল রশিদ মালয়েশিয়া থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগে যতবার মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়েছে, ততবারই দুই দেশের একটি চক্র দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ কলিং ভিসার দুর্নীতি নিয়ে মালয়েশিয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তার শাস্তিও হয়েছে। এবারও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাঠে নেমেছেন। বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত, যাতে সাধারণ মানুষ প্রতারিত না হয়।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম শামছুন নাহার গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবারই সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হবে।’ ১৫ লাখ লোক আদৌ যেতে পারবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে মালয়েশিয়া বলেছে। কিন্তু আমরা যদি পাঁচ লাখ লোকও পাঠাতে পারি, সেটা আমাদের সফলতা। এর বেশি লোকও যেতে পারে।’
মালয়েশিয়ার একটি চক্রের হাতেই কাজ যাচ্ছে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় কারা অনলাইন পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটা তাদের দেশের সরকারের ব্যাপার। আমরা আমাদেরটা ঠিক রাখব।’ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করবেন কীভাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরাও বিষয়টি ভাবছি। আমাদের পর্যবেক্ষণব্যবস্থা থাকবে। কেউ অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.