আগারগাঁওয়ে নতুন ভবন, আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

Spread the love

রক্তে শিহরণ জাগাবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

শরিফুল হাসান


শরিফুল হাসান

আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ভবন। জাদুঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, একাত্তরের দলিলপত্র, চিঠি ও বার্তা মিলিয়ে অন্তত সাড়ে ১৭ হাজার নিদর্শন রয়েছে। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো
আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ভবন। জাদুঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, একাত্তরের দলিলপত্র, চিঠি ও বার্তা মিলিয়ে অন্তত সাড়ে ১৭ হাজার নিদর্শন রয়েছে। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো

অস্ত্র হাতে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা যাচ্ছেন অভিযানে। কখনো গাদাগাদি করে তাঁরা ঘুমাচ্ছেন এক কক্ষে। চোখের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত পোশাক আর অস্ত্র। একাত্তরের এমন ছবি মনে শিহরণ জাগাবে। আবার নারী নির্যাতন কিংবা বুদ্ধিজীবী হত্যার দলিলগুলো দেখে যে কেউ হয়ে উঠবেন ক্রুদ্ধ, অশ্রুসজল। বিপরীতে নৌ কমান্ডোদের সাহসী অভিযান কিংবা বিজয়ের মুহূর্তের ছবিগুলো আনন্দিত-আলোড়িত করবে যেকোনো প্রজন্মের মানুষকে।

আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবনের গ্যালারিগুলো ঘুরলে এমন নানা অনুভূতি হতে পারে যে কারও। কারণ, এই ভবনের চারটি গ্যালারিতে একাত্তরের নানা দলিলপত্র, চিঠি, বার্তাসহ অসংখ্য আলোকচিত্র রয়েছে, যার প্রতিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস। পাঁচ হাজার বর্গফুট আয়তনের একেকটি গ্যালারি হয়ে উঠছে ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়।

নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। দীর্ঘ ২১ বছর সেখানে আলো ছড়ানোর পর সেগুনবাগিচার সেই ভবনের দরজা বন্ধ হয় ১২ এপ্রিল। আজ রোববার নতুন দরজা খুলবে আগারগাঁওয়ে, জাদুঘরের নিজস্ব ভবনে।

এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদারের হাতে শিখা অম্লান। গতকাল সেগুনবাগিচার পুরোনো ভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও নতুন প্রজন্মের ৭১ ব্যক্তি হেঁটে শিখা অম্লান আগারগাঁওয়ে নতুন জাদুঘরে নিয়ে যান l ছবি: প্রথম আলো
এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদারের হাতে শিখা অম্লান। গতকাল সেগুনবাগিচার পুরোনো ভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও নতুন প্রজন্মের ৭১ ব্যক্তি হেঁটে শিখা অম্লান আগারগাঁওয়ে নতুন জাদুঘরে নিয়ে যান l ছবি: প্রথম আলো

আগারগাঁও পঙ্গু হাসপাতালের উল্টো দিকে প্রায় দুই বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত হয়েছে নয়তলা এই নতুন ভবনটি। ভবনের ব্যবহারযোগ্য আয়তনের পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানাল, গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এবং শীতকালে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘর ঘুরে দেখা যাবে। তবে আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পরই এটি উন্মুক্ত হবে সবার জন্য।

এই জাদুঘরের প্রবেশপথে প্রথমেই চোখে পড়বে চারকোনা কালো মার্বেল পাথরে প্রজ্বলিত শিখা অম্লান। পানির ভেতর থেকে সেই শিখা জ্বলছে। গতকাল সকালেই সেগুনবাগিচার পুরোনো ভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও নতুন প্রজন্মের মোট ৭১ জন হেঁটে শিখা অম্লানটি নতুন জাদুঘরে নিয়ে আসেন। এখান থেকে ভবনের ওপরের দিকে তাকালেই একটি সত্যিকারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার চোখে পড়বে। একাত্তের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল।

গত বুধবার দুপুরে ভবনের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষো একদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর কড়াকড়ি, আরেক দিকে প্রদর্শনশালায় শেষ মুহূর্তের কাজে ব্যস্ত কর্মীরা। জাদুঘরের ব্যবস্থাপক সত্যজিৎ রায় মজুমদার প্রদর্শনশালাগুলো ঘুরে দেখালেন। তিনিই জানালেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, একাত্তরের নানা দলিলপত্র, চিঠি, বার্তা মিলিয়ে অন্তত সাড়ে ১৭ হাজার নির্দশন রয়েছে চারটি গ্যালারিতে।

নয়তলা ভবনের গ্যালারিগুলো শুরু হয়েছে চারতলা থেকে। প্রথম গ্যালারিতে রয়েছে বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কালপর্বের নানা নিদর্শন। এই গ্যালারির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম’। পাল আমল, সেন আমল, ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি সংস্কৃতির নানা নিদর্শন রয়েছে এখানে।

দ্বিতীয় গ্যালারিতে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে মার্চের ঘটনাবলি, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী সরকার গঠনের নানা পর্ব তুলে ধরা হয়েছে। ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বর্বরতাও উঠে এসেছে এই গ্যালারিতে। উদ্বাস্তু হয়ে পড়া বাঙালিদের শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে যাওয়াসহ নানা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে এই গ্যালারিতে।

তৃতীয় গ্যালারির শিরোনাম ‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’। এই গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ঘটনা, রাজাকারদের তৎপরতা, মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের ভূমিকা উঠে এসেছে। চতুর্থ গ্যালারির শিরোনাম আমাদের জয়। সম্মুখযুদ্ধ, যৌথ বাহিনীর অভিযান, বিভিন্ন এলাকায় বিজয়, বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ দিয়ে সাজানো হচ্ছে শেষ গ্যালারিটি।

জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানাল, বাছাই করা নিদর্শন গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়েছে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনা ফুটে ওঠে। অন্যগুলো সংরক্ষিত থাকবে জাদুঘরের আর্কাইভে। এ ছাড়া আরও দুটি অস্থায়ী গ্যালারি রয়েছে বিশেষ দিবসে প্রদর্শনের জন্য।

গ্যালারিগুলো ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্তে নিচে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের দেখা মিলল। কাল আপনাদের স্বপ্নের জাদুঘরের উদ্বোধন। কেমন লাগছে? জবাবে তিনি বললেন, ‘এ এক অসাধারণ অভিযাত্রা। ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচার ছোট্ট দোতলা বাড়িটিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়েছিল। একদিন এত বড় জাদুঘর হবে, সেদিন আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। যে কিশোর-তরুণেরা আমাদের সেগুনবাগিচার ওই জাদুঘর দেখেছিল আজ তারা তাদের সন্তান নিয়ে আসবে নতুন এই জাদুঘরে। এ যেন এক পরম্পরা।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.