অরক্ষিত কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন

Spread the love

শরিফুল হাসান

সেন্ট মার্টিন সমুদ্রসৈকতে এ পর্যন্ত যে ১৪ জন পর্যটক মারা গেছেন, তার ১১ জনই জেটিঘাটের উত্তর-পূর্ব পাশের এই প্রিন্স হ্যাভেন পয়েন্ট দিয়ে সাগরে নেমেছিলেন। তার পরও কোনো সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড বা নির্দেশনা লাগানো হয়নি । ছবি: প্রথম আলো
সেন্ট মার্টিন সমুদ্রসৈকতে এ পর্যন্ত যে ১৪ জন পর্যটক মারা গেছেন, তার ১১ জনই জেটিঘাটের উত্তর-পূর্ব পাশের এই প্রিন্স হ্যাভেন পয়েন্ট দিয়ে সাগরে নেমেছিলেন। তার পরও কোনো সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড বা নির্দেশনা লাগানো হয়নি । ছবি: প্রথম আলো

একটু পানি থাকলেই ‘সৈকত’ আর একটু গাছপালা থাকলেই যেন ‘বনাঞ্চল’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এ রকম চিত্র। এটুকু সুযোগ কাজে লাগিয়েই তারা পর্যটক আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। অথচ বাংলাদেশে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আর প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের মতো স্থান থাকার পরও তা অবহেলায় পড়ে আছে।
পর্যটনসমৃদ্ধ এসব এলাকা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা তো দূরের কথা, এখনো নিরাপদই হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের দিন সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে গিয়ে ডুবে মারা যান চার ছাত্র। এখনো নিখোঁজ দুজন। এ ঘটনায় সেন্ট মার্টিনের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয় তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে কক্সবাজারের সাগরে ডুবে ৮৫ জন আর সেন্ট মার্টিনে ১৪ জন পর্যটক মারা গেছেন। কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকতের ১১১ কিলোমিটার এখনো সম্পূর্ণ অরক্ষিত। নেই কোনো উদ্ধারকর্মী, নেই টহলের ব্যবস্থা। যে নয় কিলোমিটার এলাকায় টহলের ব্যবস্থা আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। আর সেন্ট মার্টিনের সমুদ্রসৈকতের কোথাও কোনো সতর্ক নির্দেশনা-সংবলিত সাইনবোর্ড নেই। নেই উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা।
তবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য তৈরি জাতীয় পর্যটন নীতিমালায় এ নিয়ে পরিকল্পনার অভাব নেই। ১৯৯২ সালে দেশের প্রথম পর্যটন নীতিমালায় কক্সবাজারের জন্য মহাপরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এর ১৮ বছর পর তৈরি জাতীয় পর্যটন নীতিমালা, ২০১০-এ বলা আছে, পৃথিবীর দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার-টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন ও সোনা দ্বীপকে কেন্দ্র করে আদর্শ অবকাশ পর্যটন গন্তব্য গড়ে তোলা হবে। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দেশের পর্যটন খাতের বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সবই কাগজে-কলমে।
২০১৩ সালে প্রকাশিত পর্যটন সক্ষমতা সূচক বা ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স (টিটিসিআই) অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩। অবকাঠামো, যোগাযোগ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবাসহ ১৪টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই তালিকা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম।
জাতীয় পর্যটন বোর্ডের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান মজিব উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে হবে। নিরাপত্তাও যে পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটা বুঝতে হবে। এসব এলাকায় কোস্টগার্ডসহ দ্রুত উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে হবে। তবে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী মনে করেন, পর্যটন এলাকাগুলোর নিরাপত্তা স্থানীয়দেরই গড়তে হবে।
অরক্ষিত সৈকত: প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক পর্যটক সমুদ্রের কোমরসমান পানিতে নেমে গোসল করেন। কিন্তু ঢেউয়ের ধাক্কায় কেউ নিখোঁজ হলে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করার তেমন প্রস্তুতি নেই।
সিলেটের হরিপুরের পর্যটক শামসুল ইসলাম বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে কর্তৃপক্ষ লাল পতাকা তুলে দিলে ছয়টা তাজা প্রাণ হারিয়ে যেত না। সরকার ইচ্ছে করলে এই সৈকতের অল্প পরিমাণ জায়গা জাল বা রশি দিয়ে ঘিরে পর্যটকদের নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে দিতে পারে। কিন্তু এসবে কারও আগ্রই নেই।

.
.

স্থানীয়রা জানান, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এখন যে উদ্ধার কার্যক্রম চলছে, সেটা গড়ে উঠেছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। ১৯৯৫ সালের ২৩ অক্টোবর সকালে ঢাকার কলেজছাত্র মিনহাজ উদ্দিন ইয়াছির (২২) বাবা-মা ও একমাত্র ছোট বোনকে নিয়ে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে গোসল করতে নামেন। এ সময় চোরাবালিতে আটকা পড়ে হারিয়ে যান ইয়াছির। এরপর তাঁর বাবা শাহাবুদ্দিন সৈকতে ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করার জন্য ডানকানের আর্থিক সহযোগিতায় ‘ইয়াছির লাইফ গার্ড স্টেশন’ গড়ে তোলেন। গত ১৩ বছরে এই স্টেশনের আটজন ডুবুরি সৈকতের পাঁচ কিলোমিটার এলাকা থেকে ৮৫ জন পর্যটকের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে দুই হাজারের বেশি পর্যটকের প্রাণ রক্ষা করেন।
ইয়াছির লাইফ গার্ড স্টেশনের পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, গত ১৩ বছরে সৈকতের বিভিন্ন অংশে গোসলে নেমে ডুবে যাওয়া প্রায় দুই হাজার পর্যটককে তাঁরা বাঁচাতে পারলেও মারা গেছেন ৮৫ জন। আবার ১২০ কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে মাত্র নয় কিলোমিটারে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও উদ্ধারের বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, টেকনাফ, ইনানী, হিমছড়িসহ ১১১ কিলোমিটার সৈকত এখনো অরক্ষিত।
সমুদ্রসৈকত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কক্সবাজার সি-বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৈকতের দেড় হাজার ফুট এলাকাকে বিশেষ জাল বা নেট দিয়ে ঘিরে নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য দরকার প্রায় তিন কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় কাজটি শেষ করা যাচ্ছে না।
সেন্ট মার্টিনে কোথাও নির্দেশনা নেই: সেন্ট মার্টিন সমুদ্রসৈকতে কোথাও কোনো সতর্ক নির্দেশনা-সংবলিত সাইনবোর্ড না থাকায় প্রতিবছর সৈকতে ডুবে পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজন মারা যাচ্ছেন। গত ১৫ বছরে স্রোতের টানে অন্তত ১৪ জন মারা গেছেন।
২০০২ সালে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে সি-ট্রাক নামে একটি জাহাজ চলাচল শুরু করলেও বর্তমানে এ রুটে সাতটি জাহাজের পাশাপাশি অর্ধশতাধিক ট্রলার চলাচল করে আসছে। এতে করে প্রতিদিন আট থেকে ১০ হাজার পযর্টক দ্বীপে ভ্রমণ করছেন।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে হ্যাভেন পয়েন্টে মাছ শিকার করার সময় স্রোতে ভেসে যায় স্থানীয় বাসিন্দা আবুল বশর। ১৯৯৯ সালে স্থানীয় বাসিন্দা রুস্তম আলী ও ২০০০ সালে ছিদ্দিকুর রহমান মারা যান। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ সাগরে নেমে নিখোঁজ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র সালাহ উদ্দিন কাদের ছিদ্দিকী ও আসিকুল এনাম চৌধুরী। এ ছাড়া ২০১০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শফিউর, ২০১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র সাখাওয়াত হোসেন এবং ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহিনুর রহমান মারা যান। সর্বশেষ গত ১৪ এপ্রিল আহ্ছানউল্ল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় ছাত্র ভেসে যান। এর মধ্যে চারজনের লাশ উদ্ধার করলেও দুজন এখনো নিখোঁজ।
স্থানীয়রা জানান, ৮ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার সেন্ট মার্টিনের পুরো এলাকা অরক্ষিত। এখানকার কয়েকটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও কোনো ধরনের সতর্ক নির্দেশনা-সংবলিত সাইনবোর্ড না থাকায় প্রতিবছর ওই এলাকাগুলোতে পযর্টকসহ স্থানীয় লোকজন মারা যাচ্ছেন। তবে গত সোমবারের দুর্ঘটনার পর গত বৃহস্পতিবার প্রিন্স হ্যাভেন পয়েন্টে চারটি লাল নিশান উড়ানো হয়েছে।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার পর তত্কালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মহসীন চৌধুরী নিজ উদ্যোগে নির্দেশনার কিছু সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। কিন্তু বছর খানেক পর সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
সেন্ট মার্টিন ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের জন্য জীবন রক্ষাকারী টায়ার, লাইফ জ্যাকেট, ডুবুরি, বয়াসহ উপকরণ ও উদ্ধারকর্মী থাকলেও সেন্ট মার্টিনে কিছুই নেই।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রণজিত্ কুমার বড়ুয়া বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপসহ টেকনাফ উপকূলের মোট ৬০ কিলোমিটার সৈকতের কোথাও পর্যটকদের সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড বা লাল নিশানা নেই। এখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে সেখানে লাল নিশান উত্তোলন ও পর্যটকদের সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড লাগানোর চেষ্টা চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.