শরিফুল হাসান
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁর রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গোলাম আযমের মামলায় আসামিপক্ষ শান্তি কমিটি ১৯৭১ নামে ট্রাইব্যুনালে একটি বই উপস্থাপন করেছে। তাতে পিরোজপুরের রাজাকারের তালিকায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর গতকাল বৃহস্পতিবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘আজ এখানে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার রায় হচ্ছে না। দুই বারের সংসদ সদস্য বা জামায়াতে ইসলামীর নেতা সাঈদীরও রায় দিচ্ছে না ট্রাইব্যুনাল। আজ যার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হচ্ছে, তাকে জানতে হলে আমাদের ৪০ বছর পেছনে তাকাতে হবে। তখন পিরোজপুরে সাঈদীকে মানুষ চিনত দেলু নামে।’বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর বলেন, সেই সময় ৩০ বছরের যুবক সাঈদী ছিলেন রাজাকার বাহিনীর একজন সদস্য। উর্দু ভালো বলতে পারতেন বলে পাকিস্তানি সেনাদের সব অভিযানেই তিনি তাদের সঙ্গে থাকতেন।ট্রাইব্যুনালের অপর বিচারপতি আনোয়ারুল হক বলেছেন, একাত্তরে সাঈদী যে পিরোজপুরে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন, রাষ্ট্রপক্ষ তা সফলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।১২০ পৃষ্ঠার মূল রায়ের যে সারমর্ম প্রকাশ করা হয়েছে, তার ১৬ নম্বর পৃষ্ঠার ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গোলাম আযমের মামলায় আসামিপক্ষ শান্তি কমিটি ১৯৭১ নামে আদালতে একটি বই উপস্থাপনা করেছে। আসামি পক্ষের দেওয়া সেই বইয়েও পিরোজপুরের রাজাকারের তালিকায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ শীর্ষক আরেকটি বইয়েও রাজাকার হিসেবে সাঈদীর নাম এসেছে।এ ছাড়া দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বলা হয়, পিরোজপুরের একাত্তরের রাজাকার দিইল্লা স্বাধীনতার পর জনগণকে ধর্মের কথা শুনিয়ে মাওলানা সাঈদী হলেও তাঁর অপকর্মের কলঙ্ক মুছে যায়নি। ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও সাঈদীকে রাজাকার বলা হয়েছে।রায়ের ১৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাতেও রাজাকার হিসেবে সাঈদীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে। ২৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৭ মে শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে সাঈদী পিরোজপুর সদর থানার পারেরহাট বাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানান। এরপর তাঁরা আওয়ামী লীগের এবং হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি খুঁজে সেখানে লুটপাট চালান।রায়ের ২৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ভালো উর্দু বলতে পারতেন বলে সাঈদীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ইজাজ ঘনিষ্ঠ হন। আর এভাবেই সাঈদী পাকিস্তানি বাহিনীকে হিন্দু, আওয়ামী লীগের নেতা এবং স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশিদের বাড়ি দেখিয়ে দেন, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করেন। ২৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৮ মে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ ৩০-৩৫ জন রাজাকার বাদুরিয়া গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছেন।বয়স বিতর্ক: মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদীর বয়স কত ছিল—তা নিয়ে একটি পক্ষ বিতর্ক তোলার চেষ্টা করেছে। গতকাল রায়ে সেই বিষয়টিও পরিষ্কার করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের সারসংক্ষেপের পঞ্চম পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ১৯৪০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের সাউথখালিতে জন্মগ্রহণ করেন সাঈদী। তাঁর বাবার নাম ইউসুফ আলী। সাঈদী ১৯৫৭ সালে দাখিল এবং ১৯৬০ সালে বারইপাড়া মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করেন।রায়ের ৪৬ ও ৪৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদে দেওয়া হলফনামায় সাঈদী যে তথ্য দিয়েছেন সে অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের ১৮ নভেম্বর তাঁর বড় ছেলে রফিক বিন সাঈদী জন্মগ্রহণ করেন। আরেক ছেলে শামীম সাঈদী ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর মাসুদ সাঈদী এবং ১৯৭৬ সালের ৮ ডিসেম্বর নাসিম সাঈদী জন্মগ্রহণ করেন।