একই সঙ্গে স্বস্তি আর উদ্বেগের কান্না লিবিয়াফেরত প্রবাসীদের
শরিফুল হাসান
বুধবার বেলা তিনটা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ২ নম্বর টার্মিনাল। একজন একজন করে প্রবাসী বাংলাদেশি বেরিয়ে আসছিলেন বাইরে। এই দলটির সবাই এসেছেন লিবিয়া থেকে। বেশির ভাগই ফিরেছেন নিঃস্ব হয়ে, কেউ কেউ এক কাপড়ে। কিন্তু চরম বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরার স্বস্তি তাঁদের চোখেমুখে। একই সঙ্গে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তাও নিশ্চয় তাড়া করছিল। মিশ্র এ অনুভূতির কারণেই হয়তো বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এ প্রবাসীরা।এদিকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, সবাইকে এখনই লিবিয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে চায় না সরকার। শুধু যারা ‘বিপদে পড়েছেন’, তাঁদেরই ফিরিয়ে আনা হবে।গতকাল দুপুরে তিনটি ফ্লাইটে ১৭৪ জন করে মোট ৫২২ জন লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি দেশে ফেরেন। ফ্লাইট তিনটি আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে আসে। এর আগে সকালে গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটে আসেন আরও ৩৬ জন বাংলাদেশি। তাঁরা সবাই ফিরেছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায়।আইওএমের ঢাকার মুখপাত্র আসিফ মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসী এই বাংলাদেশিরা তিউনিসিয়া ও মিসর সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছিলেন।লিবিয়া থেকে ফেরা এই বাংলাদেশিদের অনেকেই দিনের পর দিন অনাহারে-অর্ধাহারে কাটিয়েছেন। গতকাল ঢাকায় বিমান থেকে নামার পরই তাঁদের হাতে একটি করে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়। অনেকেই সেই খাবার খান গোগ্রাসে। অনেকের বাড়িতে ফেরার মতো কোনো টাকা ছিল না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে এক হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। এরপর বিআরটিসির বাসে করে তাঁদের বিভিন্ন আন্তজেলা বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশন এলাকায় পৌঁছে দেওয়া হয়। দেশে ফেরা ব্যক্তিদের অভিযোগ: দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়া এই প্রবাসীদের সরকারের প্রতি অভিযোগ বিস্তর। বিশেষ করে, সীমান্তে প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থানের সময় দূতাবাস বা সরকারের অন্য কেউ তাঁদের কোনো খোঁজখবর নেয়নি বলে সবার অভিযোগ। লিবিয়ার ক্রম-অবনতিশীল পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হাজার হাজার বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট সরকারি উদ্যোগ না থাকার সমালোচনা করেন অনেকে।বিমানবন্দরে সিলেটের শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ত্রিপোলি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়া সীমান্তে পৌঁছান। তখন সীমান্তে তাঁদের সহায়তা করতে কেউ ছিল না।নরসিংদীর সাইফুল থাকতেন জিলতান শহরে। তিনি বলেন, এক রাতে তিন ঘণ্টা হাঁটার পর ট্রাকে করে তিউনিসিয়া সীমান্তে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে দেখেন, হাজার হাজার বাংলাদেশি। তাঁদের সহায়তা করতে দূতাবাসের কাউকে দেখেননি সাইফুল।ময়মনসিংহের আবদুল মজিদ বলেন, তিনি দেখেছেন, অন্য দেশের লোকজন সীমান্ত পার হওয়ার পরপরই তাঁদের দূতাবাসের লোকজন এসে সহায়তা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কেউ ছিলেন না। নরসিংদীর বাদল মিয়ারও একই অভিযোগ।হবিগঞ্জের মাসুদ বলেন, সীমান্তে পৌঁছার আগে একদল উচ্ছৃঙ্খল লিবীয় তাঁর ক্যামেরা, মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। ঢাকার নবাবগঞ্জের রবিউল জানান, জিলতান শহরের একটি কোরীয় কোম্পানিতে তাঁরা ২৫০ জন বাংলাদেশি চাকরি করতেন। একদিন রাতে ক্যাম্প লুট হলে তাঁরা তিউনিসিয়া সীমান্তে পালিয়ে যান।কসমো নামের একটি কোরীয় কোম্পানির কর্মী চাঁদপুরের মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, কোম্পানি তাঁদের ১৫০ জনকে গাড়িতে করে সীমান্তে পৌঁছে দেয়।ফরিদপুরের সুজাত বলেন, ‘আড়াই লাখ টাকা খরচ করে মাত্র নয় মাস আগে বিদেশে গিয়েছিলাম। এখন চলে আসতে হলো। সামনে কী হবে, জানি না।’গাজীপুরের আলমগীর হোসেন, ভৈরবের সাখাওয়াত হোসেন, টাঙ্গাইলের আবদুর রউফসহ ৪৬২ জন বাংলাদেশি কাজ করতেন উন নামের একটি কোরীয় নির্মাণ-প্রতিষ্ঠানে। গোলযোগ শুরুর পর তাঁরা চলে যান সীমান্তে। তাঁরা সারা দিনে শুধু একটি করে রুটি খেয়ে সাত দিন কাটিয়েছেন। সাত দিন পর মিসরের বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা আসেন। এরপর আইওএমের সহায়তায় তাঁরা দেশে ফিরলেন।একই ধরনের বিপন্নতা, দুর্ভোগ আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনার কথা শোনান শরীয়তপুরের আজাদ, নওগাঁর ইমরান খান, টাঙ্গাইলের আবদুল আলিম, নড়াইলের নাসির ফকির প্রমুখ।সবাইকে ফিরিয়ে আনা হবে না: বাংলাদেশিদের ফেরা উপলক্ষে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, প্রস্তুতি থাকলেও সবাইকে এখনই ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী নয় সরকার। কেবল যাঁরা বিপদে পড়েছেন, তাঁদেরই নিরাপদে সরিয়ে আনা হবে। মন্ত্রী জানান, এখন যাঁরা দেশে ফিরছেন, পরবর্তী সময়ে লিবিয়ায় লোক পাঠানোর সময় তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন।প্রবাসীকল্যাণ-সচিব জাফর আহমেদ খান, পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া দেশে ফেরা প্রবাসীদের দেখভাল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপও ছিলেন বিমানবন্দরে।এর আগে ভোরে লিবিয়া থেকে আরও ৩৬ জন প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফেরেন। প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের কর্মকর্তা মাহফুজুল হক জানান, ডেস্কের সহায়তায় তাঁরা যাঁর যাঁর বাড়িতে রওনা হন।আজ ফিরবেন ২৫০ জন: লিবিয়া থেকে আরও ২৫০ জন বাংলাদেশির আজ বৃহস্পতিবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আটটি ফ্লাইটে তাঁরা ফিরবেন। এর আগে গত সোম ও মঙ্গলবার দুই দিনে ১১২ জন লিবিয়া থেকে ফিরেছেন।গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান: লিবিয়ায় আটকে পড়া বাংলাদেশিদের নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোনো সংবাদ প্রচার না করার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বাংলাদেশিদের উদ্ধার এবং তাঁদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান এ আহ্বান জানান। ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর মাইগ্র্যান্টস রাইটস বাংলাদেশ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মিজানুর রহমান শ্রমিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে যা যা প্রয়োজন, সব করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে আটটি দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে আছে লিবিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিরাপদ আশ্রয়ের নিশ্চয়তা ও জরুরি খাদ্যের ব্যবস্থা করা, প্রবাসীকল্যাণ তহবিল থেকে তাঁদের বিশেষ সহযোগিতা দেওয়া, পুনর্বাসনে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া এবং ইউরোপসহ বিভিন্ন স্থানে নতুন শ্রমবাজার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া।