শরিফুল হাসান
ইফতারসামগ্রী সামনে রেখে গোল হয়ে বসে আছেন তাঁরা। ছয় বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষ আছেন। পরিবারের ছোট শিশুরা বারবার জানতে চাইছে, ইফতারের আর কতক্ষণ বাকি। একটু পরেই আজানের ধ্বনি ভেসে এল। সবাই একসঙ্গে ইফতার শুরু করলেন।
কোনো ইফতার মাহফিল নয়, এটি একটি পারিবারিক ইফতারের চিত্র। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শ্যামলীর ৪ নম্বরের সড়কের একটি বাসায় গিয়ে যৌথ পরিবারের ইফতারের এমন দৃশ্য পাওয়া গেল। এই শহরে যেখানে স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান একসঙ্গে বসে ইফতারের সময় হয় না, সেখানে বাবা-ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, ভাগনে-ভাগনি, তাঁদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানেরা মিলে একসঙ্গে ইফতারের দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
এই ভবনের মালিক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নুর ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী শাহানা ইসলাম। তাঁরা বলেন, পাঁচতলা এই ভবনে তাঁদের সঙ্গে ছেলের পরিবার থাকে। ভবনের বাকি তলাগুলো তাঁদের দুই মেয়েসহ আত্মীয়স্বজনের কাছে ভাড়া দেওয়া। সব মিলিয়ে এই ভবনে তাঁদের আত্মীয়র সংখ্যা ৪০-এর মতো। সারা বছরই তাঁরা একে অন্যের পাশে থাকেন। তবে রোজায় ইফতারকে কেন্দ্র করে এই যূথবদ্ধতা হয় অন্য রকম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার করেন।
ভবনের তিনতলায় নুর ইসলাম, তাঁর স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ ও এক নাতি থাকে। তিনতলার আরেক পাশে থাকেন ছোট মেয়ে সামিয়া ইসলাম ও তাঁর স্বামী মো. আহসান উজ জামান। দুজনই চাকরি করেন একটি মানবাধিকার সংস্থায়।
ভবনের নিচতলায় ভাড়া থাকে নুরুল ইসলামের ভাগনে মোশতাক আহমেদের পরিবার। দোতলায় থাকেন ভাগনি মরিয়ম নেছা ও তাঁর স্বামী। আরেক পাশে থাকেন ভাগনে ইশতিয়াক আহমেদ, তাঁর স্ত্রী মুনসেফা আহমেদ, দুই সন্তান স্বার্থক ও সোহা। চারতলায় থাকেন নুর ইসলামের বড় মেয়ে মুনিয়া ইসলাম ও তাঁর স্বামী শফিউর রহমান। দুজনেই দুটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। তাঁদের দুই সন্তান সপ্তর্ষী আর মুনাহিদ। চারতলায় আরেক পাশে থাকেন নুর ইসলামের ভাগনে সাজেদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীন।
যে যেখানেই থাকেন, ইফতারের সময় সবাই তিনতলায় হাজির হন। এভাবে পারিবারিকভাবে ইফতার করতে কেমন লাগে, জানতে চাইলে নুর ইসলামের বড় জামাই শফিউর রহমান বলেন, ‘খুব ভালো লাগে। সবাই সবার খোঁজখবর জানতে পারি।’
নুর ইসলামের ছেলে সামিউল ইসলাম বলেন, পারিবারিক পরিবেশ কার না ভালো লাগে।
নুর ইসলাম বলেন, ২০০০ সালে তিনি আর তাঁর স্ত্রী এই জায়গাটি কেনেন। চাকরির শেষে এসে বাড়ির কাজ শুরু করেন। ২০০৫ সালে নিচতলায় উঠে আস্তে আস্তে অন্য তলার কাজ শেষ করেন। এখন সবাই মিলে থাকছেন। ঢাকায় বসে তিনি গ্রামের বাড়ির আবহ পান।
নুর ইসলাম বলেন, তাঁরা যেসব খাবার দিয়ে ইফতার করেন, তার কিছুই বাইরে থেকে আনতে হয় না। সবই বাসায় বানানো। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি এর নাম দিয়েছি “শাহানার হোটেল”।’
নুর ইসলামের এই কথা শুনে পাশে বসা স্ত্রী শাহানাও হাসলেন। কেমন লাগে শাহানার হোটেল শুনতে? বললেন, ‘আমার ভালোই লাগে। একসঙ্গে সবাই মিলে খাচ্ছি। থাকছি। বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে। আসছে, যাচ্ছে। এটা-ওটা আবদার করছে। আমি চাই পারিবারিক এই বন্ধন টিকে থাকুক আজীবন।’