মোজাম্বিকে আটক ৪২ বাংলাদেশি, তানজানিয়ায় ৫

Spread the love

অবৈধ পথে দক্ষিণ আফ্রিকা

শরিফুল হাসান

আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক হয়ে সড়কপথে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঢুকতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪২ জন বাংলাদেশি। দেড় মাস ধরে তাঁরা মোজাম্বিকের একটি পুলিশ ক্যাম্পে বন্দী। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের অপেক্ষায় এখন তানজানিয়ায় আটকা পড়ে আছেন পাঁচজন বাংলাদেশি। খাবারের অভাবে চরম কষ্টে আছেন তাঁরাও। সড়কপথে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঢুকতে গিয়ে এ বছরের শুরুতে গ্রেপ্তার হন ৩৭২ জন বাংলাদেশি। বছরের বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন আরও অনেকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত আড়াই শ জন সর্বস্ব খুইয়ে জেল খেটে দেশে ফিরেছেন। আর গত বছর লাইবেরিয়ায় গিয়ে প্রতারিত হয়ে তিন মাস জেল খেটে দেশে ফিরেছেন ৩৯ জন বাংলাদেশি। পূর্ব আফ্রিকার দেশ বুরুন্ডিতে গত বছরের জুনে ২৩ জন বাংলাদেশিকে আটক করে পুলিশ। তাঁদের সবাইকে সড়কপথে অবৈধভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা নেওয়া হচ্ছিল। আটক এই বাংলাদেশি এবং দেশে থাকা তাঁদের পরিজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রপ্তানির নামে প্রতারিত করছে বিদেশগামীদের। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানোর কথা বলে তাঁরা একেকজনের কাছ থেকে নেন ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। এরপর বাংলাদেশ থেকে তাঁদের প্রথমে দুবাই নেন। দুবাই থেকে নেওয়া হয় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। সেখান থেকে রাতে মোজাম্বিক সীমান্ত দিয়ে সড়কপথে তাঁদের দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। আর এটি করতে গিয়ে পথে পথে ধরা পড়ে জেল-নির্যাতন ভোগ করছেন বাংলাদেশিরা। মোজাম্বিকে আটক ৪২ জন: প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তাঁরা বর্তমানে মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুতুর ১৮ নম্বর স্ট্রিটের একটি ক্যাম্পে আছেন। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হলুদিয়া ইউনিয়নের মৌর্ছা মান্দা গ্রামের দ্বীন ইসলাম ও জুয়েলও আছেন এই ক্যাম্পে। দ্বীন ইসলামের ভগ্নিপতি বজলুল রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্বীন ইসলামকে একটি দোকানে কাজ দেওয়ার কথা বলে সাড়ে ছয় লাখ টাকা নেয় দালাল। ১ জুলাই দ্বীন বাংলাদেশ ছাড়ে। কয়েক দিন আগে সে ফোন করে জানায়, মোজাম্বিকে প্রবেশের সাত দিনের মাথায় তারা গ্রেপ্তার হয়েছে।’মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে দ্বীন ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, ঢাকা থেকে তাঁদের উড়োজাহাজে মুম্বাই নেওয়া হয়। সেখানে এক দিন রেখে নেওয়া হয় দুবাই। দুবাই থেকে মোজাম্বিক। সেখান থেকে সড়কপথে তাঁদের নেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। এরপর তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু সাত দিন পর ২০ জুলাই পুলিশ তাঁকে ও জুয়েলকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের পাসপোর্টে মোজাম্বিকের ভিসা থাকায় সে দেশে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ক্যাম্পে আরও ৪২ জন বাংলাদেশি আছেন। সবাই অবৈধভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। দ্বীন ইসলামের মুঠোফোন থেকেই কথা হয় মুন্সিগঞ্জের জুয়েল; নোয়াখালীর বেলাল, ইকবাল, রানা, আওলাদ হোসেন; কুমিল্লার জিয়াউর রহমান, আবদুর রহিমসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। প্রত্যেকেই জানালেন, তাঁরা ভয়াবহ কষ্টে আছেন। সারা দিনে এক বেলা খাওয়া জোটে। পোকামাকড় কামড়াচ্ছে। জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তানজানিয়ায় পাঁচজন: নোয়াখালীর শাহাবুদ্দিন (২৯)। চট্টগ্রাম থেকে দুবাই হয়ে তাঁকে নেওয়া হয় তানজানিয়ায়। দুই মাস ধরে সেখানেই আটকা পড়ে আছেন তিনি। শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আছেন আরও পাঁচ বাংলাদেশি। দিনে এক বেলা খেতে দেওয়া হয় তাঁদের। শাহাবুদ্দিনের বড় ভাই নূরউদ্দিন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জমিজমা বিক্রি করে সাত লাখ টাকা জোগাড় করে তাঁরা টাকা দিয়েছিলেন স্থানীয় দালাল মাসুদকে। মাসুদ বলেছিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় ভালো বেতনের চাকরি দিয়ে পাঠানো হবে। কিন্তু কয়েক দিন আগে মুঠোফোনে শাহাবুদ্দিন তাঁর ভাইকে জানান, তাঁরা এখন তানজানিয়ায় আটকা পড়ে আছেন। যোগাযোগ করলে তানজানিয়া থেকে শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুন মাসের মাঝামাঝি সময় আমাদের পাঁচজনকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নেওয়া হয়। সেখান থেকে একটি ফ্লাইটে করে নেওয়া হয় দুবাই। আমাদের আগে বলা হয়েছিল দুবাই থেকে মাপুতু (মোজাম্বিকের রাজধানী) নেওয়া হবে। কিন্তু নেওয়া হয় তানজানিয়ায়। তানজানিয়ায় নামার পর শাকিল নামের এক দালাল একটি বোর্ডিংয়ে নিয়ে তোলে। শাকিল জানায়, কয়েক দিনের মধ্যে সবাইকে সড়কপথে মাপুতু নিয়ে যাবে। সেখান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু শাকিল হঠাৎ একা মোজাম্বিক চলে যায়। এখন আমরা কী করব বুঝতে পারছি না।’ শাহাবুদ্দিনের সঙ্গেই আছেন আলাউদ্দিন, সজীব, শহীদুল ও আরজু নামের আরও চার বাংলাদেশি। তাঁরা জানান, তিন মাস ধরে তাঁরা সেখানেই আটকা পড়ে আছেন। এক বেলা-আধা বেলা খেয়ে কোনো মতে বেঁচে আছেন। তানজানিয়ার ইরালা নামক স্থানে তাঁদের রাখা হয়েছে।আলাউদ্দিনের দুলা ভাই মমিনুল্লাহ প্রথম আলোকে জানান, ‘এলাকার দালাল মাসুদ দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানোর কথা বলে সাত লাখ টাকা নিছে।’ আরজুর মামা মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দালাল খালেকের মাধ্যমে মাসুদ তিন লাখ ২১ হাজার টাকা নেয়। কথা ছিল পৌঁছানোর পর বাকি টাকা দেব। কিন্তু তারা এখন তানজানিয়ায় আটকা পড়ে আছে। আমি খালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে খালেক বলছে, দু-এক দিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু দিন আর শেষ হচ্ছে না।’এর আগে আটক ৩৭২: এ বছরের জানুয়ারিতে জাল ভিসা নিয়ে অবৈধভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করে গ্রেপ্তার হন ৩৭২ জন বাংলাদেশি। পরে তাঁদের মোজাম্বিকের একটি পাহাড়ি ক্যাম্পে আটক রাখা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভালো কাজের কথা বলে তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সাত থেকে আট লাখ করে টাকা নিয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সির দালালেরা। আটক এই বাংলাদেশিদের বেশির ভাগেরই বাড়ি নোয়াখালী, ফেনী ও চাঁদপুরে। তাঁদের কয়েকজন দেশে ফিরেছেন। তাঁদের একজন চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ধামালুয়া গ্রামের এরশাদ উল্লাহ। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাঁদপুরের ১০-১২ জনসহ ৩৮ জন একসঙ্গে ঢাকা থেকে দুবাই আসি। দুবাই থেকে আমাদের নেওয়া হয় ইথিওপিয়া। সেখানে শাকিল নামের এক দালাল আমাদের সঙ্গে দেখা করে। এরপর ইথিওপিয়া থেকে বিমানে করে আমাদের মোজাম্বিকের মাপুতু নেওয়া হয়। ১৫ জানুয়ারি রাতের আঁধারে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করি। কিন্তু সকাল নয়টায় সাদা পোশাকে পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে। আমাদের ১৫ দিন দক্ষিণ আফ্রিকার জেলে রাখা হয়। আমাদের পাসপোর্টে মোজাম্বিকের এক মাসের ভিসা ছিল। তাই সেখান থেকে আমাদের মোজাম্বিক পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’এরশাদউল্লাহ জানান, মোজাম্বিকের পাহাড়ি একটি ক্যাম্পে ছিলেন তাঁরা। সেখানে গিয়ে তিনি কয়েক শ বাংলাদেশিকে আটক অবস্থায় দেখেন। এরপর পুলিশ তাঁকেসহ আরও অনেককে দেশে পাঠিয়ে দেয়। কার মাধ্যমে গিয়েছিলেন জানতে চাইলে এরশাদউল্লাহ বলেন, ‘চাঁদপুরে আমাদের দালাল ছিল হালিম। সে এখন পালাই গেছে। আর শাকিল কোথায় আছে আমি জানি না। তবে এরা সবাই বিশাল একটি চক্র। বিমানবন্দরের পুলিশও তাদের সঙ্গে আছে।’ দালালদের ভাষ্য: অবৈধ এই তৎপরতার সঙ্গে জড়িত হিসেবে হালিম, খালেক, মাসুদ এই দালালদের নামই ঘুরে-ফিরে এসেছে। আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই কাজের সমন্বয় করে শাকিল নামে বড় আরেক দালাল। তবে আটক বাংলাদেশিদের দাবি, এর সঙ্গে বিমানবন্দর পুলিশ, ট্রাভেল এজেন্সিসহ প্রভাবশালী অনেক লোকও জড়িত। দালাল খালেকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেখানে এখন কাজের দারুণ সুযোগ। দুইটা উপায় আছে যাওয়ার। একটা ডাইরেক্ট (সরাসরি) সাউথ আফ্রিকা। তাতে বেশি খরচ পড়বে। আরেকটা মোজাম্বিক হয়ে সাউথ আফ্রিকা। এখানে সাড়ে ছয় লাখ লাগবে। তবে দেখা করে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে।’ তিনি মতিঝিলে লোক নিয়ে গিয়ে দেখা করতে আসতে বলেন। আরেক দালাল মাসুদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনি আমার নম্বর কই পেলেন? আপনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। নইলে আমি কিছু বলব না।’ শাকিলের বিষয়ে জানতে চাইলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা জানিয়েছেন, আগে নানাভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় লোক যেত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার-সংকটের পর একশ্রেণীর দালাল দক্ষিণ আফ্রিকায় জনশক্তি রপ্তানির নামে অবৈধ ব্যবসায় নেমেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.