বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর করুণ দশা

Spread the love

প্রবাসী বেড়েছে ৩৫ গুণ জনবল ২৮ বছর আগের

শরিফুল হাসান

২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ২২ হাজার ২২৪ জন নারী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে শুধু লেবাননেই গেছেন ১৩ হাজার ৬২ জন। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। নেই শ্রম কর্মকর্তাও। ফলে লেবাননে নির্যাতিত প্রবাসী নারীরা বিপদে পড়লে সহায়তার জন্য কোথাও যেতে পারেন না।শুধু লেবাননেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেড় লাখ নারীসহ প্রায় ৭০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। এদের দেখভালের জন্য অনেক দেশেই বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। যেসব দেশে দূতাবাস আছে, সেখানে আবার প্রচণ্ড জনবল-সংকট। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদেশের বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো এখনো ১৯৮২ সালের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী চলছে। সে সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল দুই লাখের মতো। ২০১০ সালে এসে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ। কিন্তু এখনো দূতাবাসগুলো ২৮ বছর আগের জনবল-কাঠামো দিয়েই চলছে। ৫৮টি দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস আছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই ৫৮টির মধ্যে নয়টিতে হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতের পদ খালি রয়েছে। ১১টি দেশে কর্মরত আছেন মাত্র ১৪ জন শ্রম কাউন্সিলর। বাকি দূতাবাসগুলোতে শ্রম শাখা বা শ্রম কর্মকর্তাও নেই। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসসহ (বায়রা) বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলরসহ জনবল বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে অনেকবার দাবি জানিয়েছে। পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীও জনবল বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, দূতাবাসের কর্মকর্তার সংখ্যা অবশ্যই বাড়াতে হবে। সংসদীয় কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এক বছর আগেই লোকবল বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। আট দূতাবাসে হাইকমিশনার নেই: পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে জানান, বর্তমানে নাইরোবি, জাকার্তা, আংকারা, কায়রো, মাস্কাট, বার্লিন, ব্যাংকক ও ত্রিপোলি দূতাবাসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারের পদগুলো শূন্য আছে। জনবল-সংকটের কারণে শ্রমবাজার বাড়ানোর কাজটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।দূতাবাস ৫৮, শ্রম কাউন্সিলর ১১ দেশে: প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের ৫৮টি দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস থাকলেও শ্রম কাউন্সিলর আছেন মাত্র ১১ টিতে। প্রবাসীদের অভিযোগ, ভালো হোক মন্দ হোক শ্রম কর্মকর্তা থাকলে অন্তত সেখানে যাওয়া যায়। কিন্তু সেটি না থাকলে প্রবাসী শ্রমিকদের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। বর্তমানে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় দুজন করে চারজন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি ও দুবাইতে একজন করে দুজন শ্রম কর্মকর্তা বা সচিব আছেন। বাকি আটজন কাজ করছেন কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, লিবিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইরাকে। প্রবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মী রয়েছেন সৌদি আরবে। ১৯৭৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৫ লাখ ৭৩ হাজার ১২৯ জন কর্মী সৌদি আরবে গেছেন। এর মধ্যে মহিলা আছেন ৩১ হাজার ২৬৩ জন। এই ২৫ লাখ লোকের দেখভালের জন্য মাত্র দুজন শ্রম কর্মকর্তা আছেন সৌদি আরবে।সৌদি প্রবাসী প্রকৌশলী ফকরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, রিয়াদ ও জেদ্দা উভয় দূতাবাসেই ভিড় লেগে থাকে। দুজন কর্মকর্তার পক্ষে ২৫ লাখ লোকের দেখভাল করা সম্ভব হয় না। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবাও মেলে না।বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমবাজার বাড়ানো, শ্রমিকদের চাকরি-বেতন-জেল-জরিমানাসহ সার্বিক বিষয় দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলররা। কিন্তু ৬৫ থেকে ৭০ লাখ লোকের জন্য মাত্র ১৪ জন শ্রম কর্মকর্তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যে খাত থেকে বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা আসে সেই খাতে একটু বিনিয়োগ করলে সমস্যা কোথায়? ১৪ জনের জায়গায় ১০০ জন শ্রম কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া উচিত। প্রবাসীকল্যাণ সচিব জাফর আহমেদ খান বলেন, ৪৮টি দেশে বাংলাদেশের শ্রম কাউন্সিলর নেই। সেখানে শ্রম কাউন্সিলর থাকলে প্রবাসীরা আরও বেশি সেবা পেত। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বুর্যোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এটি সত্যি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম শ্রম কাউন্সিলর রয়েছেন। তবে বর্তমান সরকার দূতাবাসগুলোতে অতিরিক্ত শ্রম কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।যেসব দেশে জরুরি: জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক যাচ্ছেন লেবাননে। কাজেই সেখানে একটি দূতাবাস খোলা জরুরি। এ ছাড়া জর্ডান, ইতালি ও গ্রিসে প্রায় ৩০ হাজার করে বাংলাদেশি আছেন। কিন্তু সেখানেও কোনো শ্রম কাউন্সিলর নেই। দক্ষিণ আফ্রিকা, রুমানিয়া, মিসর, সুদান, ব্রুনাই, মরিশাস এই দেশগুলো বাংলাদেশের জনশক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই সেখানে দূতাবাস খোলা ও শ্রম কাউন্সিলর নিয়োগ দেওয়া জরুরি। বায়রা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সরকার সুদান, ইতালি, সৌদি আরবের মদিনা, দাম্মাম, জেদ্দা ও রিয়াদে আরও অতিরিক্ত সাতটি শ্রম উইং চালুর কথা বলেছিল। কিন্তু এক বছর হয়ে গেলেও এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বাড়ছে না বাজার: শ্রম কাউন্সিলরদের একটি বড় কাজ বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ। কিন্তু লোকবলের অভাবে সেটি হয়ে উঠছে না। বায়রার নেতারা জানিয়েছেন, তিন দশক ধরে বাংলাদেশের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবে সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়াসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাজারও হারাচ্ছে।একাধিক শ্রম কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, চাহিদাপত্র সত্যায়ন আর পাসপোর্টের কাজ করতে করতেই তাঁদের দিন চলে যায়। এ ছাড়া দুর্ঘটনা, মৃত্যু এসব তো আছেই। ফলে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের জন্য সত্যিকার অর্থে তাঁরা কোনো কাজ করতে পারেন না। মালয়েশিয়া-ফেরত তানভীর আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, ২০০৯ সালে তিনি মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েছিলেন পাসপোর্ট-সংক্রান্ত কাজে। কিন্তু তিনি কারও সঙ্গে এক সপ্তাহে দেখাই করতে পারেননি।সৌদি প্রবাসী আরিফুর রহমান বলেন, সেখানে ভারত, পাকিস্তান বা ফিলিপাইনের কেউ বিপদে পড়লেই দূতাবাসের কর্মকর্তারা ছুটে যান। শ্রমিকদের খোঁজখবর করেন। কিন্তু মারা গেলেও বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দেখা মেলে না।কুয়েত প্রবাসী কামরুল ইসলাম বলেছেন, দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মনোভাব বদলানো উচিত। স্বতন্ত্র অভিবাসন ক্যাডার দাবি: জনশক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী কর্মীদের দেখভালের জন্য একটি স্বতন্ত্র অভিবাসন ক্যাডারের দাবি জানিয়েছেন। বায়রার যুগ্ম মহাসচিব শামীম আহেমদ প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন ক্যাডারের লোকজনকে প্রেষণে শ্রম কাউন্সিলর হিসেবে দুই-তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ফিরে এসে তাঁরা আবার অন্য কাজে চলে যান। স্বতন্ত্র একটি অভিবাসন ক্যাডার হলে তাঁরা প্রবাসীদের দেখভালসহ সার্বিক কাজ সুচারুরূপে করতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.