শরিফুল হাসান
বাগেরহাটের মংলায় সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের বাড়ি। একটু ভালো থাকার আশায় সহায়সম্বল বিক্রি করে ৩৫ বছরের এই যুবক লিবিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিন লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে গোল্ডেন লাইন নামের একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি জুলাই মাসে লিবিয়ায় যান। কথা ছিল, গেলেই মিলবে ভালো পরিবেশে ভালো বেতনের একটা চাকরি। কিন্তু লিবিয়ার মাটিতে পা দিয়েই তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয়। এক মাস ধরে জেলে অনাহারে, পুলিশের নির্যাতনে দিন কাটছে তাঁর।একই অবস্থা নওগাঁর দেলোয়ার হোসেন, ঢাকার আব্দুল হাই, বগুড়ার তপনচন্দ্র দেবনাথসহ ৮৩ জন যুবকের। এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা লিবিয়ার সিরোদ থানায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসব যুবকের এখন একটাই আকুতি—এই দোজখ থেকে মুক্তি চাই।লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস ও জেলখানায় থাকা বন্দীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোল্ডেন লাইনের মাধ্যমে ৮৪ জন বাংলাদেশি গত ২ জুলাই লিবিয়ায় এসে পৌঁছায়। ওই কোম্পানির লিবিয়ার এজেন্ট সালাম তাঁদের ত্রিপোলি বিমানবন্দরে গ্রহণ করেন। লিবিয়ার আল মাখদুম কোম্পানির মাধ্যমে তাঁদের নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও সালাম তাঁদের ত্রিপোলি থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে বেনগাজি শহরে নিয়ে যান। সেখানে একটি খামারে তাঁদের দিনে ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা খাটানো হতো। কিন্তু খাবার দেওয়া হতো সারা দিনে মাত্র একবার। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করা হতো। এখানে ২৪ দিন টানা কাজ করানোর পর কোনো বেতন না দিয়েই আব্দুস সালাম নামের এক পাকিস্তানির কাছে তাঁদের বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই পাকিস্তানি তাঁদের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে সারা দিন না খাইয়ে কাজ করাতে থাকেন এবং একইভাবে নির্যাতন শুরু করেন। এ সময় সেখান থেকে একজন পালিয়ে যান এবং পুলিশকে খবর দেন। ১৫ আগস্ট পুলিশ এসে তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করে বেনগাজি এয়ারপোর্ট থানা হাজতে নিয়ে যায়। সেখানে ১৮ দিন রাখার পর ৩ সেপ্টেম্বর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় সিরোদ থানায়। বর্তমানে তাঁরা সবাই এখানেই আছেন। এখানে আসার পর দূতাবাস ও দেশের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য থানার পুলিশ তাঁদের একটি মোবাইল ফোন দিয়েছে।গতকাল এই বন্দীদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে মোবাইলে যোগাযোগ করা হয়। এ সময় কথা হয় সিদ্ধার্থ, দেলোয়ার, রানাসহ অনেকের সঙ্গে। দেশ থেকে ফোন এসেছে শুনে অনেকেই এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। সিদ্ধার্থ শংকর প্রথম আলোকে বলেন, এই জেলখানা চত্বরের একটা জায়গায় পুলিশ তাঁদের দুই দিন খোলা আকাশের নিচে রেখেছিল। খাবার দেয়নি। কয়েক দিন পর তাঁদের ৮৩ জনকে একটি বড় কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন সবাই সেখানে আছেন। পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই তাঁদের মারধর করে। ২৪ ঘণ্টায় একবার একটি রুটি দেওয়া হয় তাঁদের।শ্রমিকেরা জানান, গোল্ডেন লাইন কর্তৃপক্ষ তাঁদের ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে দেড় থেকে দুই লাখ, এমনকি তিন লাখ টাকাও নিয়েছে। গোল্ডেন লাইন অ্যাসোসিয়েটের মালিক ওমর ফারুক এখন সৌদি আরবে আছেন। প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এম এস আলী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, লিবিয়ায় এই প্রথম তাঁরা লোক পাঠালেন এবং প্রথমবারেই এমন সমস্যা হলো। এরই মধ্যে সেখানকার এজেন্ট সালামকে বাংলাদেশে ডেকে আনা হয়েছে এবং তাঁর কাছ থেকে পুরো ঘটনা জানার চেষ্টা চলছে।বন্দী বাংলাদেশিদের ব্যাপারে জানতে লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও শ্রম কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইলে ও ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়। দূতাবাসের শ্রম কর্মকর্তা আকবর হোসাইন গতকাল প্রথম আলোকে জানান, দূতাবাস এই বন্দীদের মুক্তির জন্য সার্বিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২৫ আগস্ট লিবিয়ার শ্রমমন্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।আকবর হোসাইন জানান, ৭ সেপ্টেম্বর আবারও তাঁরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং দূতাবাসের পক্ষ থেকে এই কর্মীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা বলেন। কিন্তু পুলিশ বলছে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের লিখিত আবেদন ছাড়া তাঁদের মুক্তি দেওয়া হবে না। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ জোরগানির সঙ্গে দেখা করে তাঁরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। জোরগানি জানিয়েছেন, তাঁরা দ্রুত বিষয়টির সমাধান করবেন। দূতাবাস এ ক্ষেত্রে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি।