মাস খানেক আগেও সিঙ্গাপুরে জঙ্গি সন্দেহে ১৩ জনকে আটক করা হয়। এবার সেই সিঙ্গাপুরেরই একটি প্রথম সারির প্রকাশনী ইথোস বুক থেকে প্রকাশিত হলো এক বাংলাদেশি নির্মাণশ্রমিকের কবিতার বই। সিঙ্গাপুরের এই বাংলাদেশি কবির নাম মুকুল হোসেন (২৫)।
মুকুলের আমি প্রবাসী কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি সংস্করণ মি মাইগ্র্যান্ট প্রকাশিত হয়েছে ১ মে। ৬৮ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক সংস্করণের বইটি রিভিউয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ২৭টি দেশে।
সিঙ্গাপুরের পুরোনো সংসদ ভবনে আয়োজিত প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সে দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মাহবুব উজ-জামান, ইথোস বুক প্রকাশনীর প্রকাশক ফং হো হেং, সিঙ্গাপুরের কবি মার্ক নেয়ার, অধ্যাপক তান লাই ইয়ং, মানবাধিকারকর্মী দেভি ফর দাইস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। গতকাল সোমবার ‘বাংলাদেশি কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স পোয়েট্রি বুক পাবলিশড ইন সিঙ্গাপুর’ শিরোনামে দীর্ঘ এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে সিঙ্গাপুরের প্রভাবশালী দৈনিক স্ট্রেইট টাইমস।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে জীবিকার তাগিদে সিঙ্গাপুর চলে গিয়েছিলেন মুকুল। দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম। সেই কষ্টের জীবনটা বৃথা মনে হতো। রাত জেগে সেই দুঃখ-কষ্ট, নিঃসঙ্গতা আর দেশের জন্য মন কেমন করার কথা লিখতেন মুকুল। কখনো কখনো সিমেন্টের বস্তার গায়ে লিখেছেন কবিতা। ধীরে ধীরে সিঙ্গাপুরের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে।
গতকাল দীর্ঘক্ষণ মুকুলের সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলায় দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে। কিন্তু সব সময় আমি গান বা লেখালেখি নিয়ে ছিলাম সেই ১২ বছর বয়স থেকেই। আমি চেয়েছিলাম এমন কিছু করতে, যা দিয়ে মানুষের কথা বলব। আমাকে সবাই চিনবে। বিদেশে শ্রমিকের কাজ করতে এসেও সেই শখ ছাড়িনি। আমি আমার কবিতায় দেশের কথা, প্রবাসীদের কষ্টের কথা তুলে এনেছি।’
লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার পানবাড়ী গ্রামে ১৯৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন মুকুল। বাবা কৃষক। পাঁচ ভাই, তিন বোনের সংসার। মুকুল ভাইবোনের মধ্যে সপ্তম। জীবিকার তাগিদে ২০০৮ সালে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে পাড়ি দেন সিঙ্গাপুরে। এ জন্য জমি বেচতে হয় তাঁর পরিবারকে। মাঝখানে ছিল দালালদের প্রতারণা। সিঙ্গাপুর এসে কাজ না পাওয়া। একপর্যায়ে বিক্রি করতে হয় মায়ের নেকলেসও।
কেমন কেটেছে জীবন? মুকুল জানালেন, ‘সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা সাতটা বা রাত আটটা পর্যন্ত সেই কাজ চলত। সব সময় দুশ্চিন্তা কীভাবে টাকা তুলব। মা-বাবা যে বসে আছে। সিমেন্টের বস্তা, ভারী মালামাল বহন করতে খুব কষ্ট হতো। গরমে একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ি। অনেক দিন মন খারাপ করে রাত জেগে ছিলাম।’ প্রবাসজীবনের এসব দুঃখ-কষ্ট আর পেছনের জীবনের কথা কবিতায় তুলে আনেন তিনি। কখনো কখনো সন্ধ্যায় কাজ শেষে বের হয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কিংবা রুমের এক কোণে বসে লিখতেন দেশের কথা, শৈশব-কৈশোরের কথা, প্রেমের কথা। কখনো কখনো রাত তিনটা পর্যন্ত জেগেও লেখালেখি করেছেন। লিখতে লিখতে কখনো কখনো নিজের কক্ষে বসেই কাঁদতেন।
মুকুল একসময় সিঙ্গাপুরের শ্রমজীবীদের মুখপত্র বাংলার কণ্ঠ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক এ কে এম মোহসিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মুকুল তাঁর পত্রিকার সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লেখেন। লেখক ফোরাম কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সেখান থেকেই সিঙ্গাপুরের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়।
মুকুল জানান, একসময় পরিচয় হয় সিঙ্গাপুরের কয়েকবার স্বর্ণপদকজয়ী কবি সিরিল অংয়ের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা হয়। এরপর সিরিলের পরামর্শেই ইংরেজিতে কবিতার বই বের করার স্বপ্ন দেখেন। সিরিলই ইথোসের প্রকাশক ফং হো হেংকে প্রস্তাব দেন ইংরেজিতে মুকুলের বই প্রকাশের। স্ট্রেইট টাইমস-এ প্রকাশিত গতকালের নিবন্ধে ফং হো বলেছেন, মুকুলের কবিতা তাঁকে মুগ্ধ করেছে। তিনি জানান, ১৯৯৭ সালে ইথোস প্রতিষ্ঠিত হলেও এই প্রথম কোনো অভিবাসীর কবিতার বই বের হলো।
কেমন লাগছে জানতে চাইলে মুকুল বলেন, ‘আমি তো বেশি দূর পড়াশোনা করিনি। আমার বাবা-মা হয়তো গর্ব করে বলতে পারবেন না তাঁর ছেলে প্রকৌশলী, ডাক্তার কিংবা ব্যারিস্টার হয়েছে। কিন্তু তাঁরা বলতে পারবেন তাঁদের ছেলে একজন খ্যাতিমান লেখক।’
মুকুলের সাফল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর মা কুলছুম বেগম বলেন, ‘ছেলেটা ছোটবেলা থাকি গান গাইত আর কবিতা লেকত। শুনছি ওর নামে একটা বই বেরাইচে। আমি এগুলা ভালো বুজি না। আপনারা সবাই ওকে ভালোবাসলেই আমরা খুশি। ও আরও বড় হউক।’