নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১১

Spread the love

জনতার রায় আজ

শরিফুল হাসান


কে বেশি শক্তিশালী—নেতা না জনতা? কেমন জনপ্রতিনিধি চাই নারায়ণগঞ্জবাসীর—সন্ত্রাস-দুর্নীতি মামলার আসামি নাকি পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি? নির্বাচন কমিশন কি পারবে তাদের সর্বশেষ নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ করতে?এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর মিলবে আজ রোববার। কারণ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আজ ভোটের দিন। ১৬৩টি কেন্দ্রে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত টানা ভোট দিয়ে সব প্রশ্নের জবাব দেবেন চার লক্ষাধিক ভোটার।তবে, শেষ সময়ে নাটকীয় ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনের আবহাওয়া পুরোটা পাল্টে দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার গতকাল গভীর রাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। বিএনপির অভিযোগ, সেনা মোতায়েন না হওয়ায় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ফলে নির্বাচনে এখন মেয়র পদে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং শামীম ওসমানের মধ্যে। গত ২২ সেপ্টেম্বর এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এরপর প্রার্থী সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের বারবার বৈঠক, দলীয় সমর্থন নিয়ে জটিলতা, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে আপত্তি এবং এক প্রার্থীর জঙ্গি হামলার আশঙ্কাসহ অনেক নাটকীয়তা তৈরি হয়। ক্ষণে ক্ষণে বদলায় পরিবেশ-পরিস্থিতি। সর্বশেষ সেনা মোতায়েন না করায় তৈরি হয় ভিন্ন পরিস্থিতি। আর এর সূত্র ধরে নির্বাচন বর্জন করলো বিএনপি। তারপরেও আলোচিত দুই প্রার্থী নিয়েই সব উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মেঘ কাটিয়ে আজ ভোটের উৎসব আলো ছড়াবে নারায়ণগঞ্জে, এমনটাই আশা নির্বাচন কমিশনের।নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেনাবাহিনী থাকুক বা না থাকুক, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। হয় সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, নইলে নির্বাচন বন্ধ হবে। এর বাইরে আমরা ভিন্ন কিছু ভাবছি না।’এই নির্বাচনে মেয়র পদে ছয়জন প্রার্থী থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত দুই প্রার্থীর মধ্যে। কেননা ব্যালট পেপারে নাম থাকবে তৈমুর আলম খন্দকারের। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির জন্য নির্বাচনে আলোচিত প্রার্থী সাবেক পৌর মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। ১৯৭৪ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে তাঁর বাবা আলী আহাম্মেদ চুনকা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৩৭ বছর পর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করতে চান আইভী।আলোচিত-সমালোচিত আরেক প্রার্থী শামীম ওসমান। সাবেক এই সাংসদ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নানা অভিযোগ ও মামলা মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি দেশে আসেন। এই নির্বাচন তাঁর কাছে রাজনীতিতে ফেরার লড়াই।আতঙ্ক কাটিয়ে উৎসব: সেনা মোতায়েন হচ্ছে না—এমন খবরে শুক্রবার শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও গতকাল উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরে আসে। শহরের জিয়া হলের সামনে সকাল থেকেই নির্বাচনী সরঞ্জাম বিতরণ শুরু হয়। সারা দিন এ প্রক্রিয়া চলে। সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় করে। শহরের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাব-পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে মহড়া দেয়।নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গতকাল বিকেলে মহড়া শুরু করে র‌্যাব। র‌্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের পাঁচ শতাধিক সদস্য, শতাধিক গাড়ি ও মোটরসাইকেল মহড়ায় অংশ নেয়। এ ছাড়া ডগ স্কোয়াডের একটি দল শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে তল্লাশি চালায়। র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলও মহড়ায় অংশ নেয়। উৎসুক নগরবাসী র‌্যাবের এই মহড়া প্রত্যক্ষ করে। সন্ধ্যায় শহরে বিপুলসংখ্যক সংবাদকর্মী ও পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।ভোটার সংখ্যা: নারায়ণগঞ্জ শহর, বন্দরের কদমরসুল ও সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। মোট ভোটার চার লাখ চার হাজার ১৮৯ জন। পুরুষ দুই লাখ তিন হাজার ৩৭৫ জন ও নারী ভোটার দুই লাখ ৮১৪ জন।শহরের নয়টি ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৬২ হাজার ২২১। ভোটকেন্দ্র ৫৯। সিদ্ধিরগঞ্জের ভোটার এক লাখ ৪৪ হাজার ৩৮৬। ভোটকেন্দ্র ৬৩। বন্দরের ভোটার ৯৭ হাজার ৫৮১ জন। ভোটকেন্দ্র ৪১।অন্য তিন মেয়র প্রার্থী: আলোচিত তিন প্রার্থীর বাইরে আরও তিন প্রার্থী আছেন। তাঁরা হলেন স্বতন্ত্র আতিকুর রহমান (নান্নু মুন্সী) (গরুর গাড়ি), আতিকুল ইসলাম জীবন (তালা) ও শরীফ মোহাম্মদ (হাঁস)। এ ছাড়া ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ২৫২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সংরক্ষিত নয়টি মহিলা ওয়ার্ডে প্রার্থী আছেন ৫৬ জন।নয়টি ওয়ার্ডে ইভিএম: ইভিএম ব্যবহার করা হবে নয়টি ওয়ার্ডে। এসব ওয়ার্ডের ৫৮টি কেন্দ্রের ৪৫০টি বুথে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে ৭, ৮, ৯, ১৬, ১৭, ১৮, ২২, ২৩ ও ২৪।গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ১২৬: মোট কেন্দ্র ১৬৩। এর মধ্যে ৩৭টি কেন্দ্র সাধারণ এবং ১২৬ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে নির্বাচন কমিশন এগুলোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র’ বলছে। যাতায়াতব্যবস্থার সমস্যা, অতীতের অবস্থা এবং ভোটার সংখ্যা হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে।ফল প্রকাশে স্বচ্ছতা: নির্বাচনের ফলাফল তৈরিতে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান জানান, ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে থাকবে বিশেষ স্বচ্ছতা। ১৬৩টি কেন্দ্রের প্রতিটিতে পৃথকভাবে ফল প্রকাশ করা হবে। এরপর সেই ফল পাঠানো হবে মূল নিয়ন্ত্রণকক্ষ জিয়া হল মিলনায়তনে। ফল ঘোষণার সময় প্রার্থী ও তাঁর এজেন্ট উপস্থিত থাকবেন। সবাই যেন ফল দেখতে পান, সে জন্য জিয়া হলের বাইরে প্রদর্শনী বোর্ড থাকবে।নিরাপত্তাব্যবস্থা: র‌্যাব ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচ হাজার সদস্য সক্রিয় থাকবেন। প্রতিটি কেন্দ্রে থাকবেন পুলিশ ও আনসারের ২৪ জন সদস্য। পুলিশের টহল দল থাকবে ৮২টি। প্রতি দলে একজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে থাকবেন পাঁচজন করে সদস্য। ২৭টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে থাকবে পুলিশের স্ট্রাইকিং ফোর্স।রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি সাধারণ ভোটকেন্দ্রে অস্ত্রসহ সাতজন পুলিশ, ব্যাটালিয়ন আনসার একজন, ১৪ জন আনসার, ভিডিপিসহ মোট ২২ জন দায়িত্ব পালন করবেন। অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে থাকবেন ২৪ জন সদস্য।নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও ফতুল্লায় রিজার্ভ ফোর্সও থাকবে। ফতুল্লা সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে হলেও নির্বাচন এলাকার পাশে হওয়ায় সেখানেও কড়া নিরাপত্তা থাকবে। নদীতে থাকবে কোস্টগার্ড। নয়জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ২৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও থাকবেন।জেলা পুলিশ সুপার শেখ নাজমুল আলম প্রথম আলোকে জানান, কোনো অবস্থাতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে দেওয়া হবে না। কেউ সে চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।দেড় হাজার র‌্যাব-সদস্য: নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে মোট ১৪০০ র‌্যাব-সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। নির্বাচনের পরে আরও দুই দিন পর্যন্ত তাঁরা নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করবেন। নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাব-১১-এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) এস এম মোস্তফা।লে. কর্নেল মোস্তফা বলেন, ‘বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ও ডগ স্কোয়াডও আনা হয়েছে। ভোটারদের ন্যূনতম ভয়ভীতির কোনো কারণ নেই। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে চেকপোস্ট থাকবে। যেসব কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোতে বিশেষ নজরদারি রাখা হচ্ছে। তালিকাভুক্ত কোনো সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা না হলেও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সরকারি তোলারাম কলেজে সংবাদ সম্মেলন করেন র‌্যাবের মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে র‌্যাব সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।এক হাজার দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক: নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে দেশের ১৮টি পর্যবেক্ষক সংস্থা। এসব সংস্থার ২৩৭ জন কর্মী নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি পেয়েছেন। এ ছাড়া আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও অনুমোদন পেয়েছে। এগুলো হলো: রয়েল অ্যাম্বাসি অব সুইজারল্যান্ড, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই), ইউএসএইড, মার্কিন দূতাবাস, ইউএনডিপি, কানাডীয় হাইকমিশন ও নরওয়ে দূতাবাস।এ ছাড়া দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার মধ্যে খান ফাউন্ডেশন, ডেমক্রেসিওয়াচ, গণকল্যাণ সংস্থা (জিকেএস), মানবিক সাহায্য সংস্থা, ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স, পিআরপিএসএফ, আইইডি, ব্রতী, ইনোভেশন, জানিপপ, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, ডরপ, বামাশপ, হিউম্যান রাইটস, আভা ডেভলপমেন্ট সোসাইটি, হোমস্টেট সোসাইটি, পার্লামেন্ট ওয়াচ, এফ আর ফাউন্ডেশন, আইন সহায়তা কেন্দ্র ও স্বনির্ভর ওয়ার্ল্ড নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে।রিটার্নিং কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পর্যবেক্ষকেরা সর্বোচ্চ পাঁচজনের দলে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। কাউকে কোনো কেন্দ্রে দলবদ্ধভাবে অবস্থান করতে দেওয়া হবে না। তবে ইভিএম ব্যবহূত নয়টি ওয়ার্ডের ৫৮ কেন্দ্রের ৪৫০টি ভোটকক্ষে যেকোনো পর্যবেক্ষক সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবেন।আট শর বেশি সংবাদকর্মী: নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে আট শরও বেশি সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী অনুমতিপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে তিন শতাধিক কর্মী বেসরকারি টিভি চ্যানেলের।নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে শতভাগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান। গতকাল সন্ধ্যায় শহরের জিয়া হলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।ফিরে দেখা: ১৮৭৬ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা হয়। তবে এর প্রথম নির্বাচন হয় স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৭৭ ও ২০০৩ সালে এই পৌরসভার নির্বাচন হয়। এ বছরের ৫ মে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা, বন্দরের কদম রসুল ও সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গঠিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.