শরিফুল হাসান
বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া মানে প্রতি পদে পদে ভোগান্তি দুর্ভোগ। মাঝে মধ্যে ভীষণ হতাশ লাগে! আজ সকালের কথা বলি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার ট্রেনের টিকিট লাগবে ১৯ তারিখের। এই দেশে একটা ট্রেনের টিকিট পাওয়াটাও কতোটা ভোগান্তির বলে বোঝানো যাবে না। আপনি বেশিরভাগ সময় শুনবেন টিকিট নেই। টিকিট টাকার একটা এপস আছে কিন্তু সেখানে বলবে টিকিট নাই। স্টেশনে যাবেন টিকিট নাই। কিন্তু কালোবাজারে পাবেন। যাই হোক, ১৯ তারিখের টিকিট লাগবে। সোনার বাংলা বা তূর্ণা।সকাল পৌনে ৮ টা থেকে বসে আছি মোবাইল নিয়ে। ৮টায় টিকিট দেওয়া শুরু হবে। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও সার্ভারে ঢুকতে পারলাম না। শুরু হলো অপেক্ষা।
কয়েক মিনিট পর সার্ভারে ঢুকতে পারলাম। ৩ টা টিকিট সিলেক্ট করে পেমেন্ট অপশনে গেলাম। এরপর পেমেন্ট নিচ্ছে তো নিচ্ছে সেই অপেক্ষা আর শেষ হয় না। ১০ মিনিট অপেক্ষার পর বেরুলাম। আবার শুরু থেকে সিলেক্ট সিলেক্ট করার পর এবার বলছে টিকিট শেষ! তার মানে ১৯ তারিখের টিকিট ১০ মিনিটে শেষ, যাত্রার বাকি আরো পাঁচদিন! এখন কারো ট্রেনের টিকিট লাগলে কোথায় যাবে? আর মাত্র ১০ মিনিটে এতো টিকিট কারা কাটে?
কী আর বলবো! টিকিট নিয়ে এই ভোগান্তির শেষ নেই! কেউ কেউ বলতে পারেন তিনদিনের ছুটি তাই চাপ পড়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করেন এটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই দেশে ট্রেনের টিকিট মানেই সারাজীবন দুর্ভোগ! আমি গত ৩০ বছর ধরে তাই দেখছি। আমি জানি না এই দুর্ভোগের শেষ কোথায়!
রেল নিয়ে আমার কিছুদিন রিপোর্ট করতে হয়েছে। একদিকে দেখেছি রেলের হাজার কোটি টাকার জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে আরেকদিকে হাজার কোটি টাকার নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়ার পরেও রেলসেবার মান বাড়ছে না। আমি আজও বুঝি না ১৭ কোটি লোকের দেশে ট্রেন কী করে বছরের পর বছর লস করে! লাখ লাখ লোক ট্রেনে চড়তে চায় কিন্তু টিকিট নেই।
আচ্ছা পাঁচদিন আগে টিকিট দেওয়া হয়। আপনারা যদি দেখেন চাহিদা বেশি অতিরিক্ত বগি দেন। অতিরিক্ত ট্রেন দেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে কী করে ট্রেন লস করে সেটা কোনভাবেই আমার মাথায় আসে না। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট নেয়া হয় কিন্তু রেলের কোন উন্নতি হয় না। টিকিটের দাম বাড়ে তাও সেবা বাড়ে না। অবশ্য সেবা তো পরের কথা ট্রেনের টিকিট মানেই তো ভোগান্তি! জানি না কোনদিনও এই ভোগান্তির শেষ হবে কী না!
শুধু কী রেল! ঈদের আগে দেখবেন টিকিটের জন্য ১৮-২০ ঘন্টা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে। যে এপস আছে তাতে আপনি সপ্তায় সর্বোচ্চ চারটা টিকিট করতে পারবেন। আপনার পরিবারের সদস্য যদি বেশি হয় তাহলে ট্রেনে যাবেন না আসার টিকিট করবেন?
আমি জানি না মোবাইল, এনআইডি এসব থাকার পরেও এমন কোন প্রযুক্তি বের করা কঠিন কী না যেখানে কে টিকিট কাটছে, কে চড়ছে, কতোবার টিকিট কাটছে এগুলো বের করা খুব কঠিন কী না! আসলে কী রেলব্যবস্থা, রেলসেবা, রেলের টিকিটিং এগুলোর উন্নতি করার সুযোগ নেই?
দেখেন ঢাকার আশপাশে অন্তত ২০ টা জেলা আছে যেগুলো দিয়ে ট্রেনে এক ঘন্টায় ঢাকা আসা সম্ভব। এই জেলাগুলো থেকে প্রতি ঘন্টায় ভালো ট্রেন আসলে তাদের তো ঢাকায় থাকতে হয় না। আমি জানি না রেলসেবার মান আর কবে বাড়বে? রেল মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন এসবে হাত দিয়েছিলেন। দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন। তারপর তাঁর কী হলো আমরা জানি!
শুধু ট্রেনের টিকিট বলছি কেন এই দেশে নাগরিক সেবা মানেই ভয়াবহ দুর্ভোগ! ঢাকায় রোজ অফিসে যাওয়া আর আসা মানে জীবন শেষ! প্রতিদিনই যানজট বাড়ছে ভয়াবহভাবে কিন্তু আপনি কোন সমাধান দেখবেন না। গত কয়েক মাস ধরে যানজট যেন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারো কোন বিকার নেই। শুধু রাস্তা না, বাস, ট্রেন, লঞ্চ সর্বত্রই এখানে নৈরাজ্য!
শুধু যাতায়াত ব্যবস্থা না, সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা নিতে যান। দেখবেন একটা সিট পাওয়া কতো কঠিন! কারণ হাজার হাজার রোগী! ডাক্তার, নার্স, ডায়াগোনিসিস সব মিলে যে একটা সিস্টেম সেই সিস্টেমের বেহাল দশা! ডাক্তার ভালো তো নার্স নেই, নার্স আছে তো পরীক্ষার যন্ত্র নষ্ট! সবমিলে ভয়াবহ দুর্ভোগ!
শিক্ষার দিকে নজর দেবেন, সেই একই অবস্থা! জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল? পাসপোর্ট করতে যাবেন? ড্রাইভিং লাইসেন্স? ওয়াসার সেবা? ভূমি অফিস? রাজউক? পৌরসভা? থানা? আদালত? বাজার? আপনি যদি এই দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হন তাহলে রোজ বুঝবেন জীবনটা কেমন!
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করলাম আমরা! দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু নাগরিক সেবার ভয়াবহ অবস্থা। আমার মতো যারা এই দেশেই থাকতে চায় তাদের রোজ যুদ্ধ করতে হয় এই শহরে, এই দেশে! আরেকদিকে দেখি একদল লোক হতাশায় দেশ ছাড়ছে। শিক্ষিতরা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা। কেউ যাচ্ছে পড়তে কেউ আর না আসতে! যাদের সেই শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই তারা কেউ যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকদল আফগানিস্তান, সিরিয়ার যুদ্ধবিদ্ধস্ত নাগরিকদের সঙ্গে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে যাচ্ছে ইউরোপে। এখান থেকে পরিত্রানের কোন উপায় কী নেই?
দেখেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করলাম আমরা! সেবাখাতগুলো কেন আরো ভালো হবে না? এই যে দুর্বিসহ অবস্থা সেটা আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। আমাদের সরকার, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, গনমাধ্যম, নাগরিক সমাজ সবার সম্মিলিত ব্যর্থতা। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। কিন্তু পরিস্থিতি উত্তরণে সেক্টর ধরে ধরে কেন আমরা সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবো না। কেন এই শহরের যানজট দূর হবে না? কেন পাসপোর্ট করতে এতো ভোগান্তি লাগবে? এনআইডি দেখেই কেন ২৪ ঘন্টায় পাসপোর্ট হবে না? কেন গণপরিবহন ব্যবস্থা ভালো হবে না? কেন রেলের টিকিট ব্যবস্থা ঠিক হবে না?
আমি মনে করি এই দেশের প্রত্যেকটা সমস্যা সমাধানযোগ্য। দরকার শুধু জবাবদিহিতা, সুশাসন। দরকার আন্তরিকতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমাদের নীতি নির্ধারকদের সন্তানরা যদি সব বিদেশে থাকে, তাদের সারা জীবনের ভাবনা যদি থাকে বিদেশে বেগমপাড়া গড়া তাহলে কিন্তু সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না। আপনার সমস্যাগুলো বুঝতে চাইলে নিজেরা পাবলিক বাসে চলুন, ট্রেনে চলুন। সরকারের সব সেবা নিতে যান। অবস্থাটা বুঝবেন এবং বুঝবেন কেন এগুলো সমাধান জরুরী।
রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকসহ সবার কাছে অনুরোধ, সবার কাছে আকুতি, চলুন দেশটা ঠিক করি। দেশটাকে আরেকটু বসবাসযোগ্য করি। নাগিরকদের দুর্ভোগগুলো কমাই। আমি যে এই বাংলাদেশেই থাকতে চাই আজীবন!